১৮৬৬ সাল । আমেরিকার এক রাজ্য নিউ জার্সি। কালো যুবক জন হেনরীর বয়স মাত্র ১৮ বছর। হেনরী ছিলেন প্রতিবাদী চরিত্রের। কোথাও অন্যায় দেখলে গর্জে উঠতেন ,প্রতিবাদ করতেন। এসব কারনে জন হেনরী সুপরিচিত হয়ে উঠলেও নিউ জার্সির বর্ণবাদী পুলিশ চার্লস বার্ড তাকে দুই চোখে দেখতে পারতো না। এক বার ডলার চুরির মিধ্যে অপবাদ দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে ভার্জিনিয়ার কারাগারে পাঠালো সে। জন হেনরীর কোন স্বাক্ষী ছিল না, পুলিশী প্রমাণে, আদালতের বিচারে জন হেনরীর দীর্ঘ ১০ বছরের কারাদন্ড হয়ে গেলো। ভার্জিনিয়ার কারা প্রকোষ্ঠে দু:সহ দিন কাটতে লাগল জন হেনরীর।
সে সময়ে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে সুড়ঙ্গ কেটে রেল লাইনের কাজ চলছিল। এই কঠিন কাজের জন্য দরকার ছিল শক্তিশালী শ্রমিকের। রেল লাইন বসানোর দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানি শক্তিশালী জেল বন্দী শ্রমিকদের চাইল- কারা কতৃপক্ষের কাছে। কারা কতৃপক্ষের কাছেও বিষয়টি লাভজনক মনে হল। তারা জেল বন্দীদের পাঠাতে লাগলো সুড়ঙ্গ তৈরীর কঠিন কাজে। এই কাজে নিয়োজিত কোম্পানি ২৫ সেন্ট করে দিত কারা কর্তৃপক্ষকে। কারা কর্তৃপক্ষ এ থেকে কয়েকটি সেন্ট হতভাগ্য শ্রমিকদের দিতো। কাজটি বেজায় কষ্টের হলেও সামান্য অর্থ আয়ের উৎসের কারনে বন্দীরাও কাজটি চালিয়ে যেতো থাকলো। সে সময়ে জন হেনরীও জেল কর্তৃপক্ষের আদেশে সুড়ঙ্গ তৈরীর কাজে নিয়োজিত হলো। জন হেনরী যে কোন কঠিন কাজকেও হাসি মুখে বরণ করে নিতে জানতো। সারাক্ষণ গান গেয়ে সে মাতিয়ে রাখতো পরিবেশ। ২০ পাউন্ড ওজনের হাতুড়ী দিয়ে কেটে কেটে সুড়ঙ্গ তৈরী হচ্ছিল। প্রথমে নাইট্রোগ্লিসারিন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর আলগা করে, হাতুড়ি , শাবল চালিয়ে তৈরী হতো পাথরের সুড়ঙ্গ। জন হেনরী হাতুড়ীর তালে তালে ,সুরে, ছন্দে গাইতো। এর ফলে খানিকটা কষ্টের উপশম হতো। শ্রমিকরা সকলে মিলে আনন্দের মধ্যে পরিশ্রম সাধ্য এই কাজটি করে আসছিলো।
একদিন খরচ বাঁচাতে কোম্পানীর লোকজন ষ্টীম ড্রিল মেশিন নিয়ে আসলো । জন হেনরী বুঝলো- একবার এই মেশিন দিয়ে পাহাড় কাটা শুরু হলে হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুরুষ কর্মচ্যুত হবে, বেকার হয়ে যাবে তারা।
শ্বেতাঙ্গ ঠিকাদারকে হেনরী বলল পাহাড় কাটায় মানুষই সেরা। হেনরীর কথা শুনে শ্বেতাঙ্গ ঠিকাদার বিদ্রুপ করতে লাগল। শ্বেতাঙ্গ ঠিকাদারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে জন হেনরী- শপথ নেন মেশিনকে পরাস্ত করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার প্রতিষ্টা করবেন।
নির্দিষ্ট দিনে লুইস ট্যানেল সুড়ঙ্গে সকাল থেকে শুরু হল পাথর ভাঙ্গা। যন্ত্রের সাথে মানুষের এক অসম প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার কথা শুনে কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুরুষ ট্যানেলের বাইরে আপেক্ষা করতে থাকে। জন হেনরীর স্ত্রী একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ট্যানেলের বাইরে অপেক্ষায়। মেসিনে ঝনঝন শব্দের সাথে হেনরীর হাতুড়ির ঠক ঠক শব্দে কেপে ওঠে লুইস ট্যানেল। একসময়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসে। শেষ হয় প্রতিযোগিতার সময়। তখন ঠিকাদারের লোকজন ট্যানেল মেপে দেখেন যন্ত্র মাত্র ৮ ফুট পাথর কাটতে পেরেছে, এই সময়ে জন হেনরী ১৪ ফুট পাথর কেটেছেন। হেনীরর জয়ে সঙ্গী শ্রমিকরা আনন্দ করতে করতে ট্যানেলে ঢুকে তাকে কাধে করে নিয়ে আসতে যায়। কিন্তু কোথায় জন হেনরী? টানেলের শেষ প্রান্তে সে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। হেনরীর এই আত্মদান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গান বাধা হয় তাকে নিয়ে। ‘দি ব্যালেড অব জন হেনরী।’ তাকে নিয়ে গান গেয়েছেন পল রবসন, হ্যারি বেলাকল্টে, পিংক অ্যান্ডারসন, লিওন বিব, লিউ বেলী, জনি ক্যাশ, স্প্রিংটন।
আমাদের দেশের গণ শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসও গান বেধেছেন জন হেনরীকে নিয়ে:
‘প্রতি মে দিবসের গানে গানে, নীল আকাশের তলে দূর
শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন, ওই হেনরীর হাতুড়ীর সুর।
জন হেনরীর এই আত্মদানে যুগে যুগে নিপীড়িত মানুষ এই গান গেয়েছে। এই গান হয়ে উঠেছে, বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার সঙ্গীত। আমাদের দেশেও ফকির আলমগীর এই গান গেয়ে থাকেন। উজ্জীবক এই গান তাই হয়ে উঠেছে নির্যাতিত, বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণীর গান। কালো মানুষ জন হেনরী, তাই আজও হাতুড়ীর ঘায়ে, গেয়ে চলেন জীবনের জয়গান। এই গান সামাজ্যবাদ, নির্যাতন কারী, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সর্বহারা মানুষের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত মানুষের কন্ঠে নিপীড়তের কন্ঠস্বর হয়ে টিকে আছে মহাকালে। মহান মে দেবিস উপলক্ষে পৃথিবী জুড়ে জন হেনরীর এই গান ছড়িয়ে যায় শ্রমিক শ্রেণী মানুষের কাছে। এই গান হয়ে ওঠে তাদের অধিকার , শক্তির প্রেরণা। আমাদের দেশেও জন হেনরী যেন চিরচেনা। তার হাতুড়ীর সুর, হয়ে উজ্জীবক শক্তির উৎস। তিনি হয়ে ওঠেন, স্থান কাল পাত্র ভেদে এক অমোঘ শক্তির উৎসধারা।
জয়তু জন হেনরী।
তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট, দি ওয়াল ব্লগ, আনন্দবাজার পত্রিকা