স্কুল ও কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটির বেশিরভাগেরই প্রথম পছন্দ থাকে মেডিকেল। মানে ডাক্তার হয়ে ওঠার। স্কুল পর্যায়ে My Aim in life, Essay লিখতে গিয়ে আমরাও লিখেছি, ডাক্তার হয়ে গরিব দুখী ও দুস্থ মানুষের মহান সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করবো। মেধার অনৈকট্যে আমরা পিছিয়ে থাকলেও আমাদের সহপাঠীরা কেউ কেউ ডাক্তার হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। পেশায় এসে তাদের শৈশবের সেই রচনার প্রতিপাদ্য বিষয় ও আদর্শকে ঝেড়ে ফেলে হয়তো অনেকে সাদা এপ্রোনের মাঝে খুঁজে নেয় সিমাহীন নাগরিক সুখ। গ্রামের স্কুল থেকে সারাজীবন প্রথম হওয়া ছেলেটি বিস্ময়কর মেধা সম্পন্ন বিস্ময় বালকটি কর্মজীবনে এসে হয়তোবা ভুলে যায় তার স্কুলের ইংরেজি শিক্ষকের কাছে দেয়া My Aim in life এর লিখিত অনানুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি। সকলের প্রিয় অতিশয় ভদ্র নম্র সেই ছেলেটি হয়তো অনেকের কাছেই আর প্রিয় হয়ে থাকতে পারে না, অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে অনেক, অজস্র। প্রতিশ্রুতি অনেকে ভাঙলেও অনেকে মানবিক দীক্ষায় তা রক্ষা করতেও বদ্ধ পরিকর থাকে। জাতির মহাসংকটে আমরা তা বারে বারে দেখতে পেয়েছি। ভালো মন্দ মিলিয়ে পৃথিবী।
ব্যতিক্রম সর্বত্রই আছে। তবু ভোগবাদী এ সমাজে ত্যাগের অপার মহিমায় কাজে মানবিক লক্ষ্য ও দক্ষতা মানে আগের যুগের মতো জান মাল বিসর্জন দিয়ে মানবিকতার উৎকর্ষে নিজেকে উৎসর্গ করার দিন এখন আর নেই। My Aim in life বা আমার জীবনের লক্ষ্য লিখতে গিয়ে যারা একজন ভালো শিক্ষক হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আমরা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমরা অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিক্রি করেছি, অনৈতিক ভাবে একজন ভালো ছাত্রকে ফেল করিয়ে পেছনের ছাত্রটিকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছি। যারা একজন সৎ পুলিশ অফিসার বা অন্য কোনো প্রথম শ্রেণির অফিসার হয়ে রাষ্ট্রের সেবা করবো বলে কথা দিয়েছি, রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো কাজ করবো না বলে কথা দিয়েছি তাদের হাতেই রাষ্ট্রের পোস্ট মর্টেম কম হয়নি যুগেযুগে। যিনি ভালো উকিল হবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তিনিই কালে হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে বড় মিথ্যাচারী আর ধোঁকাবাজদের রূপকার। যে ছাত্রটি কলেজ পরিদর্শকের সামনে সাহসে বুক ফুলিয়ে বলেছিলো – I want to be a good and honest Politician.
সেই ছেলেটিই বড় রাজনীতিবিদ হয়ে দেশ মাতৃকার স্বার্থের কথা না ভেবে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো কাজ করতে একটুও দ্বিধান্বিত হয়নি, বিবেকে বাঁধেনি। এমনি করে আমরা সবাইই আমাদের শৈশব ও কৈশরের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আসছি অবিরাম। কিন্তু জাতির মহা দুর্যোগে আমরা সকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীরা মনের অজান্তেই কেমন করে যেনো প্রতিশ্রুত হয়ে উঠি। আমাদের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা মানবিকতা হঠাৎ আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
যার সাক্ষ্য বহন করছে, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ দেশের যেকোনো মহা দুর্বিপাক। বিশেষ করে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। অন্যান্য সকলের সাথে সেদিন দেশের চিকিৎসকরাও নিরবে ঘরে বসে বা পালিয়ে বেড়াতে পারেন নি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বা পাক আর্মির হত্যা নির্যাতনের শিকার মানুষদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে জীবন বাজী রেখে দেশ মাতৃকার টানে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
আজ রণাঙ্গনে যুদ্ধ নেই বটে কিন্তু আমাদের এখন অবিরাম যুদ্ধ করতে হচ্ছে একেকবার একেকটি মহামারীর বিরুদ্ধে। তখন রাত নেই, দিন নেই, দিনের পর দিন স্বীয় পরিবার পরিজন ছেড়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ে যাওয়া অসুস্থ লোকদের পাশে পেশাগত কারনেই হোক আর মানবিক কারনেই হোক, চিকিৎসক, নার্স বা স্বাস্থকর্মীদেরই পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। আমি আগেই বলেছি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম, অব্যতিক্রম সর্বত্রই আছে।
অল্প কিছুদিন হয় গেলো এডিস মশার প্রকোপে ডেঙ্গুজ্বর। বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেছে। তবে এ হারটা বাংলাদেশেই একটু বেশি ছিলো। শহর থেকে গ্রাম গঞ্জ, স্কুল কলেজ মাঠঘাট সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজে নেমে পড়েছিলো পুরো দেশ। কিন্তু রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে, রোগীদের সুস্থ করতে এগিয়ে আসা বেশ কয়েকজন চিকিৎসকও মৃত্যুবরণ করেন আমাদের দেশে। ডাক্তার প্রতিদিন পত্রিকার অনলাইন পোর্টালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এ সংখ্যা ৯
বর্তমানে পুরো পৃথিবী এক মহা দুর্যোগের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতম অভিশাপের সাথে সাম্প্রতিক কালের মানব ইতিহাসের বিশ্বব্যাপী এতোবড় বৈশ্বিক বিপর্যয় ও যুদ্ধ বোধহয় বর্তমান প্রজন্ম আর কোনোদিন প্রত্যক্ষ করেনি। যে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের দায় ও অগ্র সেনা শুধুমাত্র চিকিৎসকরাই। গত ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে করোনা বা কোভিড ১৯ ভাইরাসের নির্মম ছোবল হানার পর চীনের প্রশাসন প্রদেশটি লকডাউন করে দেয়। চোখের পলকে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো গড়ে উঠতে থাকে একেকটি টেম্পোরারি হাসপাতাল। যে হাসপাতালগুলোতে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রিয় জীবনের মায়া সাঙ্গ করে অনেক চিকিৎসকদেরও অত্মবলীদানের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ঘৃণা আর সকল উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীন।
করোনা ভাইরাসের জন্মদাতা চীন ঘুরে দাঁড়ালেও আজ মহা ঘুর্ণাবর্তে পুরো বিশ্ব। ইতালী স্পেন জার্মান সহ ইউরোপ আমেরিকার মতো ফাস্ট ওয়ার্ল্ড খ্যাত উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে সমূলে। তবুও নিরন্তর লড়াই চলছে। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হয়ে লাশ হয়ে কফিন বন্দি হচ্ছে জীবনের চরম নির্মমতায়। কিন্তু এই অতিমানবদের মানবিক ত্যাগ তবু থেমে নেই। অতী ক্ষুদ্রকায় এ অনুজীবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরো বিশ্ব আজ দিশেহারা। যার অগ্রসেনারা হচ্ছেন প্রতিটি দেশের চিকিৎসক সহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
জানা গিয়েছে উন্নত চিকিৎসা সেবা সম্পন্ন নিউ ইয়র্কের অর্ধেক স্বাস্থ্যকর্মীই করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা অনেকেই হাসপাতালের বিছানায় নয়তো বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে। কতোজন মৃত্যুবরণ করেছেন তার সঠিক হিসাব মেলা ভার। গত সপ্তাহে সেখানে দুইজন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু ও দুই শতাধিকের বেশি অসুস্থ হওয়ায় কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি আরভিং মেডিকেল সেন্টারের কাছে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স চেয়েছেন নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতালের সুপারভাইজার।
আমেরিকান কলেজ অব ইমার্জেন্সি ফিজিশিয়ান্সের সভাপতি উইলিয়াম পি জ্যাকুইস বলেন, ‘সব জায়গায় চিকিৎসকরা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ সারা দেশে কতজন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন সেই তথ্য এই মুহূর্তে জানা সম্ভব হচ্ছে না।
মৃত্যুপুরি ইতালিতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু ১১৫৯১, তন্মধ্যে চিকিৎসক হচ্ছে ৬১, আক্রান্ত চিকিৎসক সংখ্যা ৮,৯৫৬।
কম বেশি একই অবস্থা ইরান, স্পেন, জার্মানি সহ বিশ্বের সব দেশে। যারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেবে তারাই পড়ে যায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এবং খোদ চীনকেও এমন করুণ অবস্থার সাক্ষ্য বহন করে চলতে হচ্ছে। তবুও সারা বিশ্বে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অন্যের জীবন রক্ষার্থে প্রাণপন লড়াই করে যাচ্ছেন চিকিৎসা কর্মীরা।
আজ বাংলাদেশেও এই মহাযুদ্ধের ঘনঘটা, চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মাঝে প্রতিটি মানুষ, কি হবে আমাদের? আমরা কি সামাল দিতে পারবো? আমাদের চিকিৎসা ব্যাবস্থা কতোটা আগলাতে পারবে এ মহামারী। কতোই বা দীর্ঘ হবে আমাদের মৃত্যুর বহর?
সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত অাক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৮২ হাজার। মৃত্যুবরণ করেছে ৩৭ হাজার ৫৭৮, সুস্থ হয়ে উঠেছে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার। বাংলাদেশের অবস্থা কতোটা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে তা হয়তো বোঝা যাবে আরো কয়েক দিন পর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ ৩১ মার্চ গণভবন থেকে দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা সাহস হারাবেন না, অতীতে অনেক বড় বড় দুর্যোগ অামরা সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছি, এ দুর্যোগও মোকাবিলা করবো।
রাতে একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে একটি কথা হঠাৎ আমার হৃদয়কে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিলো, এই সংগ্রামে যেসব চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়ে জীবন দিবে তাদের জন্যে আমরা কি করতে পারবো? মৃত্যুতেই কি শোধ হয়ে যাবে জাতির কাছে সব লেনাদেনা? না, তা হতে পারে না। পরিস্থিতি যতই নিয়ন্ত্রণে থাকুক বা ভয়াবহ রূপ নিক, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিন্দু পরিমান পিছু হটবার কোনোই সুযোগ নেই এই মহাদুর্যোগে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সকল অভিজ্ঞতা থেকে অধিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করে একজন চিকিৎসকেরও যেনো অকাল মৃত্যু না হয়। প্রয়োজনে বহির্বিশ্বে চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে আসা চীন কিউবার কাছ থেকে চিকিৎসা সহায়তা নেয়া যেতে পারে। যাতে এই মহামারি থেকে দেশ রক্ষা পায়।
সর্বোপরি এই মহাযুদ্ধে অংশ নেয়া চিকিৎসক নার্স সহ যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেন তাদের পরিবারের দায় গ্রহণ সহ জাতির এ মহাক্রান্তি লগ্নে সেই মহাবীরদের সম্মান বলেন, প্রনোদনা বলেন আর প্রতিদানই বলেন, তারা মূলত জাতীয় বীরের মর্যাদা পাওয়া যোগ্য এবং তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানাই। নয়তো এই মানবিক বিপর্যয়ের সুবিশাল ভার বহণের মাঝে আরেক ঋণের বোঝার ভার বয়ে চলার সামর্থ্য আমাদের সাধ্যকেও ভারক্রান্ত করে তুলবে।