দেশ ভাগের বেদনা:
একসময় বনগাঁর এই বাড়িটিই ছিলো আমাদের বসতভিটা

শামস ইমরান সৌরভ
শামস ইমরান সৌরভ
8 মিনিটে পড়ুন
ছবি: এডভোকেট শামস ইমরান সৌরভ

পশ্চিবঙ্গের বনগাঁ, একসময়ে বৃহত্তর যশোহর জেলার একটি মহাকুমা। ছোট থেকেই আমার দাদুর মুখে সর্বদাই শুনে এসেছিলাম বনগাঁর নাম। সব সময় তার স্মৃতির পাতায় ভেসে থাকতো বনগাঁর সভাইপুর গ্রামের ছবি।ছোট বেলায় জ্ঞান বুদ্ধি তেমন ছিলো না তাই মজারচ্ছলেই দাদুকে বলতাম, দাদু চলেন আমরা বনগাঁয় চলে যাই, উত্তরে দাদু বলতেন, যেতে তো প্রচন্ড ইচ্ছা করে কিন্তু সে আর কখনোই সম্ভব না!

১৯৪৭ সাল, ভারতের স্বাধীনতা তথা উপমহাদেশের মানচিত্রের ইতিহাসের সব থেকে উল্লেখযোগ্য বছর। The Indian Independence Act 1947 এর বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ছিল “বেঙ্গল ও পাঞ্জাব প্রদেশ উভয় দেশের (হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান) মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে।” এই ভাগ করার সাথে ভাগ হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্য।

দেশ ভাগের বেদনা: একসময় বনগাঁর এই বাড়িটিই ছিলো আমাদের বসতভিটা
ছবি:এডভোকেট শামস ইমরান সৌরভ

অশ্রুসিক্ত নয়নে শত বছরের ভিটে বাড়ী ছেড়ে মানুষ আজানার উদ্দেশ্যে ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে পাড়ি জমায়। ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া লক্ষ মানুষের দলের ভীড়ে আমার দাদুরাও ছিলেন। আমার দাদু সেসময়ে হোমগার্ডের ডিস্ট্রিক এডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।মাত্র বছর কয়েক আগেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের বার্মা ফ্রন্ট থেকে লড়াই করে ফিরেছেন, এর মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো দেশ ভাগের! ১৯৪৭ সালের ১৪ & ১৫ ই আগস্ট জন্ম হয় ভারত & পাকিস্তানের। কিন্তু র‍্যাডক্লিফ মহাশয়ের কলমের কাঁচিতে ১৮ই আগস্ট যশোর (বনগাঁ), খুলনা, নদীয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর সহ অনেক স্থানের মানচিত্র এদিক-ওদিক হয়ে যায়। ভাগ্য বদলে যায় হাজারো মানুষের।

আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিলো বনগাঁর সভাইপুর গ্রামে। দাদুর নাম শামসুজ্জোহা বিশ্বাস, পিতা ইমরান আলী বিশ্বাস। দাদুর পিতা মরহুম ইমরান আলী বিশ্বাস ছিলেন অত্র এলাকার গাঁতিদার এবং তার পূর্বপুরুষ নাটোরের রাণী ভবানীর জমিদারির দাপ্তরিক কার্য দেখাশোনা করতেন। দাদুর কাছে শুনেছিলাম আমাদের পূর্বপুরুষগণ ( আনুমানিক ৬/৭ পুরুষ আগে হবে) নদিয়ার কানসোনাপুর নামক স্থান থেকে বনগাঁ এসেছিলেন। কারণ ছিলো বর্গীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে। শুনেছিলাম বর্গীরা আমাদের বংশের কাউকে না কাউকে হত্যা করেছিলো। সভাইপুর গ্রামটা বাঁওড় বেষ্টিত, আক্রমণের সম্ভাবনা কম, তাই সকলে বনগাঁর সভাইপুরে স্থায়ী হয়েছিলেন।

- বিজ্ঞাপন -
দেশ ভাগের বেদনা: একসময় বনগাঁর এই বাড়িটিই ছিলো আমাদের বসতভিটা
ছবি: এডভোকেট শামস ইমরান সৌরভ

আমার দাদুর শৈশব-কৈশোর, কেটেছে বনগাঁয়, আর যৌবন কেটেছিলো কলকাতায়। ১৯০৮ সালে জন্মলাভ করেছিলেন, ১৯২৭ সালে দাদু বনগাঁ হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশনে ( বর্তমান এসএসসি সমমান) এবং ১৯২৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে এফ.এ (এইচএসসি’র সমমান) পরীক্ষা দেন এবং ফার্স্ট ডিভিশনে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে তিনি সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন পাশ করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি কলকাতার রেফারিং কলেজ থেকে ক্রিয়া বিষয়ক ডিগ্রি নেন এবং পরবর্তীতে বৃহত্তর যশোহর জিলার ডিস্ট্রিক ফিজিক্যাল অর্গানাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অনুমানিক ১৯৪০-৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ হোমগার্ডে অফিসার হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেন এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ ভারতের পক্ষ হয়ে বার্মাফ্রন্টে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

আমার দাদু দেশ ভাগের বেশ আগে বনগাঁ শহরের মতিগঞ্জ নামক স্থানে ১৫ বিঘা জায়গা কেনেন। সেখানে নির্মান করেন একটি বাড়ি। দাদীর কাছে শোনা, মতিগঞ্জের জায়গায় পুকুর খনন করে সেই মাটি দিয়ে ইট তৈরি করেছিলেন এবং সেই ইট দিয়েই বনগাঁর বাড়ী তৈরি। কিন্তু তাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সব ছেড়ে চলে আসতে হয়!

দেশ ভাগের বেদনা: একসময় বনগাঁর এই বাড়িটিই ছিলো আমাদের বসতভিটা
ছবি:এডভোকেট শামস ইমরান সৌরভ

ছোট থেকেই বনগাঁ ও সভাইপুরের কথা শুনতা এবং সেজন্য এক অন্যরকম টান অনুভব করতাম। হয়তো এটাকেই নাড়ীর টান বলে। আমার বাবা ডাঃ আহসান কবির দুএকবার সভাইপুরে গিয়েছেন কিন্তু আমার কখনই যাওয়া হয় নাই। ২০০৬ সাল পর্যন্ত যশোহরে পড়াশনা করেছি, বয়স নেহাৎ কম ছিলো। ২০০৬ সালের পর আইনের উপর অনার্স পড়তে ঢাকা অতঃপর জীবিকার জন্য দেশের পূর্বাঞ্চলে (কুমিল্লা-চট্টগ্রাম এলাকা) চলে যাই। ২০১৮ সালের অক্টোবরে যশোরে স্থায়ীভাবে চলে আসার সুযোগ হয় এবং সেই সুযোগ আর মিস করতে চাই নাই।২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই ভারতের ভিসা নিয়ে চলে যাই পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে। বেনাপোল ক্রস করে খুব সহজেই পৌছে গেলাম বনগাঁ মতিগঞ্জে। ভাষা কথাবার্তা পুরো যশোরের মতো, মনে হচ্ছিলো যশোরেই আছি। সবাই অনেক কাছের, অনেক পরিচিত! বনগাঁ শহরের মতিগঞ্জ এলাকায় দাদু যে বাড়ী তৈরি করেছিলেন সেটি গুগল ম্যাপে আমার বাবা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বর্ণনা মতে গিয়ে হাজির হলাম বনগাঁর বাড়িতে। ম্যাপ অনুযায়ী বনগাঁর বাড়ীর আশেপাশে থাকলেও যাওয়ার রাস্তা পাচ্ছিলাম না। অবশেষে পেলাম দাদুর তৈরি আমাদের সেই বাড়ীটা!

মতিগঞ্জের বাড়ীর ডিজাইন & আমাদের যশোরের বাড়ীর ডিজাইন সামনে হুবহু এক! বাড়ীর মধ্যে একজন বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন আমি কারোর খোঁজ করছি কি না?

- বিজ্ঞাপন -

নিজের পরিচয় দিলাম এবং বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বললাম, এই বাড়ীটা আমার দাদু দেশ ভাগের আগে তৈরি করেছিলেন, আমরা দেশভাগে ওপারে (যশোহরে) চলে গিয়েছিলাম। বাড়ী তালাবন্ধ ছিলো তাই জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ীতে যারা থাকেন তাদের কেউ আছেন কি না? বৌদি বললেন এখন কেউ নাই, বিকাল-সন্ধার পর আসবে।

কারণ আমি জানতাম বনগাঁর জায়গাটা আমার দাদু নগেন বাবুর কাছে দিয়ে এসেছিলেন। আরো অনেক ইতিহাস আছে, সেসবে যাচ্ছিনা সঙ্গত কারণে। ঘুরে ফিরে দেখলাম পরাতন জরাজির্ণ বাড়ীটা। দেখে খুব খারাপ লাগলো, সংষ্কারের অভাবে বাড়ীটার অবস্থা প্রায় বেহাল, যেনো ধুকেধুকে কাঁদছে। তবুও বাড়িটার যে অস্তিত্বআছে, সেটাই বা কম কি!!? অন্তত দেখতে তো পেরেছি !

ঘুরেফিরে কিছু ছবি তুললাম। খারাপ লাগছিলো দাদু-দাদী কেউ বেঁচে নাই। বেঁচে থাকলে ছবিগুলো দেখলে নিশ্চই অনেক ইমোশনাল হয়ে যেতেন।
আমি আমাদের গ্রামের বাড়ী সভাইপুরেও গেলাম। যেতেও খুববেশি একটা বেগ পেতে হলো না। বনগাঁ আদালতের পাশ থেকে অটোতে করে সহজেই পৌঁছে গেলাম পূর্বপুরুষের ভিটা সভাইপুরে। আমাদের বাড়ী যে স্থানে ছিলো এখনো সেই পাড়ার নাম আমাদের বংশের নামে, বিশ্বাস পাড়া। যদিও আমাদের বাড়ীর অবশিষ্ট কিছু নাই সেখানে। আর আমাদের বংশের তেমন কেউই আর সেখানে থাকে না। আমাদের জ্ঞাতির এক দাদী ছিলেন, উনার সাথে দেখা করলাম।
গ্রামে সে সময়ে মেলা হচ্ছিলো, সেদিন শেষদিন ছিলো, মেলার মাঠে গেলাম। মেলায় এক বয়ষ্ক ভদ্রলোকের সাথে কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করলাম “ইমরান আলী বিশ্বাস” নামে কাউকে চিনতেন কি না? পদদাদুর নাম বলতেই উনি আমার মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ চিনি, উনি তো জমিদার ছিলেন! ”
উত্তরে আমি হেসে বললাম “না, উনি জমিদার ছিলেন না, ছিলেন গাঁতিদার , উনি আমার দাদু শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের বাবা।” উনি জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কে কোথায় আছি, কি করছি, ইত্যাদি ইত্যাদি…..

- বিজ্ঞাপন -

বললেন “অনাথের (দাদুর চাচাতো ভাই) এক ছেলে বাংলাদেশ থেকে মাঝেমধ্যে আসে, আর তার আরেক ছেলে কলকাতায় আছে।”
যাই হোক উনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো, বললেন সবই তোমাদেরই ছিলো, এই মাঠ, গ্রাম, বাওড়, ইছামতি নদীর অংশ ইত্যাদি….. যদিও আমি এর সবই জানতাম। তারপরও মনের মধ্যে খারাপ লাগছিলো, ইশ! দেশভাগ মানুষের কি পরিমাণ ক্ষতি করে গিয়েছে! সেখানে দেখলাম আমাদের পাবিবারিক কবরস্থান। সেখানেই ঘুমিয়ে আছেন আমার পূর্বপুরুষেরা।

আজ ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে যখন পূর্বপুরুষের ভিটেতে যাওয়ার কথা লিখছি তখন ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে চলছে করোনার মরণ ছোবল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি করোনার এই মহামারি থেকে আমাদের যেনো তিনি মুক্তি দেন, ভাল থাকুক দুই দেশের মানুষ। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থেকে সবাই যেনো মিলেমিশে একসাথে সাথি।

সকলে ভাল থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন, মাস্ক পরবেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
এডভোকেট, জজ কোর্ট, ঢাকা।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!