এক সময়ের প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই মরা খালে পরিণত হচ্ছে। নদ-নদীগুলো পানি প্রবাহ এলাকা শুকিয়ে নদী বক্ষে মাইলের পর মাইল বিরাজ করছে ধুঁ-ধুঁ বালুচর। ভারতের মেরুকরণের প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে নিঃষ্পেষিত হয়ে উত্তরাঞ্চলের অসংখ্য নদ-নদী বক্ষে বর্তমানে পর্যাপ্ত পানি নেই। আর শাখা নদীগুলোর অবস্থা আরও করুণ। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নীচে নেমে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের সেঁচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিজ্ঞমহলের মতে, ‘ভারতের সাথে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বছরের পর বছর শুধু কালক্ষেপনই হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সীমায় যেভাবে ন্যাটিক্যাল মাইল যোগ হয়েছে ঠিক সেভাবেই আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পানি প্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি সমাধান করা যেতে পারে। আর এটির উদ্যোগ নেয়া না হলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নদী অচিরেই পরিণত হবে মিনি মরুভূমিতে।’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের অধীনে ক্রুগ মিশন এর সুপারিশক্রমে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্থান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ইপিওয়াপদা এর পানি উইং হিসাবে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রন, পানি নিষ্কাষন ও সেঁচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রধান সংস্থা হিসাবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯ মোতাবেক ইপিওয়াপদা এর পানি অংশ একই ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাইবো) সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি-১৯৯৯ ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-২০০৪ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাপাউবো আইন-২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় মন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এর নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
বিজ্ঞমহলের মতে, ‘উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বীল শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়া। দেশের পানি হিস্যা আদায়ে বহুমুখী পরিকল্পনা ও কর্মপন্থার কথা বলা হলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি আজও। তাই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে যদি ২০০ ন্যাটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কৃষিপ্রধান এ দেশকে রক্ষায় কেন আসন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে দেশের নদ-নদীগুলোতে নদী বক্ষে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ কেনো নিশ্চিত করা যাবে না?’
জানা গেছে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অতীতের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে নীচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শাখা নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আগের তুলনায় আনেক নীচে নেমে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলের গভীর-অগভীর নলকূপ থেকে পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নদী নীর্ভর এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ও অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং সেঁচ কাজে পানির অপচয় রোধ করা না গেলে বাংলাদেশ এক মহাসংকটের মুখোমুখি হবে বলে পানি বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ারী উচ্চরণ করেছেন। এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়াল, উত্তাল অনেক নদী ও শাখানদী বক্ষে বর্তমানে পর্যাপ্ত পানি আর দেখা যাচ্ছে না। করতোয়ার পরিণতিও বর্তমানে একই পথে! নাব্যতা সংকট, বাস যোগ্য পানি ও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করায় উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী থেকে দেশীয় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি’র পথে! এসব কারণে এ অঞ্চলের নদী নীর্ভর কৃষক ও এলাকাবাসীর বুকভরা আশা ক্রমশঃ হতাশায় পরিণত হচ্ছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে এসব নদ-নদী বক্ষে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-চলাচল মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকার বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ জানান, ‘ছোট বেলায় তারা ভয়াল-উত্তাল যমুনার এপাড় (পশ্চিম) থেকে ওপারে (পূর্ব) তাকালে চোখে পড়তো দিগন্তছোঁয়া পানি আর পানি । আর এখন চোখে পড়ে ধুঁ-ধুঁ বালু চর। বিজলী বাতি জ্বলা জাহাজ তো দুরের কথা! পানির অভাবে পাল তোলা নৌকাও আর দেখা যায় না। যমুনায় ভূখন্ড থেকে ৫ মানুষ সমান (দীর্ঘ) বা ৩০ ফুট গভীরে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর পাওয়া গেলেও এখন ১২/১৩ মানুষ সমান (দীর্ঘ) বা ৬০/৬৫ ফুট গভীরেরও অনেক নীচে পানির স্তর নেমে গেছে। ফলে যমুনার বিস্তৃত জলসীমা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে ও বালির চরের পরিধি বাড়ছে। ভারতের মরুকরণের কু-প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের জীব বৈচিত্র হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষক।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি বছরের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এ অঞ্চলের স্রোতস্বিনী যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী ও এর শাখা প্রশাখাসহ খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ফলে নদ-নদী বিধৌত উত্তরাঞ্চলবাসীর শুরু হয় দুঃখ দুর্দশার পালা। প্রকৃতি নীর্ভর কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের বিস্তুর্ণ এলাকা কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে ক্রমেই মিনি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। দু’চোখ নদী বক্ষের যেদিকে যায় সেদিকেই দেখা যায় ধূঁ-ধূঁ বালুচর। প্রতিবেশী দেশ ভারত নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রূদ্ধ করে দেওয়ায় সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মরু অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে নদীগুলো অবস্থান করায় মরুকরণের কু-প্রভাব এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলোর গতি প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অনেক গ্রামীন ঐহিত্য। আবহমান কাল থেকে গ্রামীন জনপদের মানুষের প্রিয় সুস্বাদু দেশী মাছ এখন সোনার হরিণের মতো। এখন আর দেখা যায়না গ্রামীণ ঐহিত্যের অনুসঙ্গ নৌকা বাইচ, খরা জাল, সূতি ফাঁদ, সেঁচের মাধ্যম দাঁড়। মৎসভান্ডার সংকুচিত বা শুকানোর ফলে অনেক মৎসজীবী বর্তমানে বেকার। আবার অনেকেই পেশার পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।
পানিসম্পদ বিষয়ক গবেষকদের মতে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার যমুনা, করতোয়া, বরাল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো নদীর পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেরও নীচে নেমে গেছে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অসংখ্য শাখা নদী ও নালা গুলোতে। এ দুরবস্থার আরও একটি কারণ হচ্ছে যমুনা নদী অববাহিকায় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় অগভীর নলকূপের ব্যবহার। এতে মরা খালে পরিনত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী, চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষি, মৎসসহ প্রকৃতি নীর্ভর বহুমূখী খাতগুলো যার নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পরিলক্ষিত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।