মোসারাত জাহান মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে! নাকি অত্মহত্যা করেছে! ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছাড়া নিশ্চিত নয় কেউই। তবুও এই দুটি প্রশ্ন ঘিরেই স্যোশাল মিডিয়ায় চলছে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা। মুনিয়া হত্যার শিকার কিংবা আত্মহনন করেছেন- এ নিয়ে নেটজেন’রা আলোচনায় নানামুখী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে এবং একজন শিল্পপতিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে!
কোন ব্যক্তিকে হত্যা কিংবা আত্মহত্যা কোনটাই কাম্য নয়। পিতামাতার মৃত্যুর পরে মুনিয়া বড়বোনের কাছেই আশ্রিত ছিলেন। বড়বোন নুসরাতই তার দেখাশুনা করতেন। তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়! কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়! একতরফাভাবে কাউকে দোষী অথবা নির্দোষী বলা যায় কি? ঘটনার অন্তরালেও থাকে ঘটনা। সেসব ঘটনার আড়ালেও থাকে কিছু চরিত্র। সে সব চরিত্রের কি ভূমিকা ছিল, সেসব খতিয়ে দেখা জরুরী।
বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও আফরোজা বেগমের পুত্র সায়েম সোবহান আনভীর ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত ও সন্তানের পিতা।
কুমিল্লার উজির দিঘিরপাড় নিবাসী মুনিয়ার বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। মা কাজী সেতারা বেগম ছিলেন ব্যাংকার। গত তিন বছর আগে মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে এবং বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কুমিল্লা সদরে তাদের বহুতল বাড়ি এবং নিজস্ব মার্কেট রয়েছে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট মুনিয়া। বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাদের দু’বোনের পারিবারিক কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। মুনিয়া মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা স্কুল থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। গত বছর (২০২০) এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও দিতে পারেননি।
ছিমছাম গড়নের সুন্দরী মুনিয়া ২০/২১ বছরের তরুণী, বাড়ি কুমিল্লায় হলেও পড়াশুনার করার জন্য একাই ঢাকায় থাকতেন। যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন, সে বাড়ির মাসিক ভাড়া ছিল ১লক্ষ টাকা এবং সার্ভিস চারজ ১১হাজার টাকা। বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে প্রণয় গড়ে ওঠে। অতঃপর ২০১৯ সাল থেকে তারা বনানীতে একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়ে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। ২০২০সালের কোন এক সময় আনভীরের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রণয় এবং একসাথে বসবাস করার বিষয়টি অবগত হলে, মুনিয়াকে ডেকে পাঠায় আনভীরের মা। তিনি মুনিয়াকে বকাবকি করেন এবং আনভীরের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে ঢাকা ত্যাগ করতে বলেন। এরপরে পরিস্থিতি শান্ত করতে আনভীর ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে মুনিয়াকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। সে সময় তিনি মুনিয়াকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি দেবেন এবং সেখানে ঘরসংসার করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরে মুনিয়া কুমিল্লায় তার বোন নুসরাত জাহানের বাড়িতে গিয়ে কয়েকমাস থাকেন। এবছরের মার্চ মাসে আনভীর ১লক্ষ টাকা মাসিক ভাড়ায় গুলশানে ফ্লাট ভাড়া নেন এবং মুনিয়া তিনি ঢাকায় ডেকে পাঠান। এই বাড়িতে মুনিয়া একাই থাকতেন এবং মাঝে মধ্যে আনভীর এই ফ্লাটে যাতায়াত করেন। গত ২৩শে এপ্রিল বাড়িওয়ালার বাসার ইফতার পার্টিতে মুনিয়া যোগ দে। সেই পার্টির ভিডিও বাড়িওয়ালী ফেসবুকে পোস্টে করেন। বাড়িওয়ালীর ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় আনভীরের পরিবারের সদস্যরা থাকায়, তারা জেনে যায় মুনিয়া এখন ঢাকায় বসবাস করছে। এই নিয়ে আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্য হয়। মুনিয়া তার বোন নুসরাতকে ফোন করে জানায়, ‘ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার পার্টিতে গিয়ে কেন ছবি তুলেছি এর জন্য আনভীর আমাকে বকা দিয়ে গালিগালাজ করেছ। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি পিয়াসা (সম্ভবত আনভীরের আত্মীয়) দেখেছেন। পিয়াসা মালিকের স্ত্রীর ফেসবুক বন্ধু। এখন পিয়াসা তার মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন। তিনি (আনভীর) দুবাই যাচ্ছেন, আমাকে কুমিল্লায় ফিরে যেতে বলেছে। আনভীরের মা জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবেন।’ মুনিয়া ও আনভীরের ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে জানা যায়, আনভীর মুনিয়াকে চোর অপবাদ দিয়ে, ৫০লক্ষ টাকা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
মুনিয়ার এই ফোনের পর কুমিল্লায় থেকে সোমবার বিকেলে ঢাকায় আসেন ওই তার বোন নুসরাত। তবে গুলশানের ফ্লাটটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পান তিনি। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শোবার ঘরে ঢুকে মুনিয়ার মৃতদেহ দেখতে পান। পরে পুলিশে খবর দিলে সোমবার সন্ধ্যার পর গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান (মুনিয়া) নামের এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানকে আসামী করে মামলায় দায়ের করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৩০শে মে দিন ধার্য করেন। এরপরেই বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভিরের বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘মুনিয়ার মৃহদেহ উদ্ধারের পর সেখান থেকে তার মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত উদ্ধারের সাথে ৬টি ডায়েরি পাওয়া যায়। এসব ডায়েরিতে কী লিখা আছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত মুনিয়ার ডায়েরী একটি পাতায় তিনি লিখেছেন, ‘আনভীরের সঙ্গে প্রেম করা আমার ভুল ছিল। বিবাহিত ও বাচ্চার বাবার সঙ্গে প্রেম করা ঠিক হয়নি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছাড়া বিয়ে হয় না। আনভীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আনভীর আমাকে ভুল বুঝেছে। তাই আমি জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাল এসে আনভীর তার ভুল বুঝতে পারবে।’
উপরোক্ত তথ্যাবলী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে পাওয়া গেছে। অনেক ঘটনা প্রতিদিন ঘটে কিন্তু সকল ঘটনা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাই পায় না। সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষেরা যখন বিবেক বিবর্জিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, সে সব ঘটনাগুলো মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং মুখরোচক আলোচনা কিংবা সমালোচনার জন্ম দেয়। এতটুকু একটি মেয়েকে কেন এভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে? এভাবে চলে যাওয়া তো কারো প্রাপ্য হতে পারে না। তবে কি আমরা সন্তানের জন্ম দিয়ে লালন পালন এবং যথার্থ মানুষ রূপে তাদেরকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি? আমাদের অর্জিত সম্পদ ও ক্ষমতার জোর আমাদের সন্তানদের কি বিপথে নিয়ে যাচ্ছে? মুনিয়ার নিথর দেহের ছবি দেখে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি বারংবার–
= ২০১৯-২০২১ এই তিন বছর ধরে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুনিয়ার সাথে আনভীরের প্রণয় সম্পর্ক কিভাবে দেখেছিলেন মুনিয়ার বোন, দুলাভাই, পরিবারের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন?
= সদ্য এসএসসি পাশ করা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুনিয়া্র সাথে বিবাহিত ও সন্তানের জনক আনভীরের প্রণয় বিষয়টি মুনিয়ার বোন, দুলাভাই জেনেও চুপ ছিলেন? কেন ছিলেন? যদি চুপ না থাকেন তবে সে সময়ে তাদের ভূমিকা কি ছিল?
= আনভীরের কাছ থেকে মুনিয়াকে সরানোর জন্য কি ব্যবস্থা নিয়েছিল পরিবার?
= আনভীরের মা এঘটনা জানার পরে মুনিয়া ভয়ভীতি দেখিয়ে কুমিল্লা পাঠিয়ে দিয়েছিল। কেননা কোন ছেলের বউ ও নাতী বর্তমান থাকতে ছেলের পরকীয়া কোন মা মেনে নিতে পারেন না। তিনি তার ছেলেকে শাস্তি না দিয়ে বরং মুনিয়াকে মানসিক নির্যাতন করেছেন।
বোনের বাড়িতে কয়েকমাস থাকার সময়ে মুনিয়ার পরিবারের কি ভূমিকা ছিল? তারা তো জানতেন আনভীরের মা মুনিয়া থ্রেট করেছেন।
– কিভাবে মুনিয়ার বোন আবার মার্চ মাসে মুনিয়াকে আনভীরের কথায় ঢাকা পাঠাতে পারে?
– মুনিয়ার বিলাসী জীবন যাপন, লক্ষ টাকা ফ্লাট ভাড়া কোথা থেকে আসতো?
– মুনিয়া পড়াশুনা নিয়মিত ছিলেন না, তবে ঢাকাতেই একা তাকে থাকতে হয়েছে কেন?
– ডায়েরীর অংশ পড়ে মনে হয়, মুনিয়া খোদায় বিশ্বাসী ছিলেন। যদি তিনি ধর্ম ভীরু হয়ে থাকেন তবে তিনি কিভাবে বিবাহ বহির্ভূত একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে ফ্লাটে থাকতে পারেন?
– আনভীর একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত হয়েছেন এবং তার সঙ্গে ২০১৯ সালে ১৭ বছর বয়সী মুনিয়ার সাথে বনানীতে ফ্লাট ভাড়া নিয়ে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে ঘর সংসার করেছেন। এটা বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী২০০৩) এর– অনুযায়ী তিনি অপরাধী? আনভীর প্রেম ও বিবাহের আশ্বাস দিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে বছরের অধিক সময় স্বামী স্ত্রী হিসেবে কাটিয়েছে। আইনত আনভীর অপরাধী নয় কি?
– আনভীর তার স্ত্রী এবং মুনিয়া দুই নারীর সঙ্গেই প্রতারণা করেছেন এবং দুজনকে ঠকিয়েছেন, নয় কি?
– কেন পরজীবী হয়ে কোন নারীকে বিলাসী জীবন যাপন করতে হবে?
বাংলাদেশে আনভীর ও মুনিয়া একটি মাত্র ঘটনা নয়। অনেক পরিবারেই এসব ঘটনা আছে। কোনটা প্রকাশিত আবার কোনটা অপ্রকাশিত। ছেলেমেয়েরা ভুল করে কিন্তু সেই ভুলের সংশোধনের দায়িত্ব পরিবারকেই গ্রহণ করলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। কতটা চাপের মুখে পড়লে একটি মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়? কিছু ধনীর দুলাল এবং ধনবান ব্যক্তি আছেন যারা ‘সুগার ড্যাডি’ নামেই পরিচিত। ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের প্রভাবে অল্পবয়সী এক বা একাধিক সুন্দরী তরুণীদের অলিখিত স্ত্রী হিসেবে পোষেন। তারা স্ত্রী’র মর্যাদা পান না, সন্তান ধারণের অধিকার পান না এবং স্বামীর সম্পত্তির অংশীদার হতে পারেন না। তবুও কিছু তরুণী এসব ‘সুগার ড্যাডি’র সঙ্গী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। হয়তো অনেক তরুণীর পরিবার এমন সম্পর্কে জড়াতে ইন্ধন যুগিয়ে থাকেন। সময় এসেছে, পরিবার ভেবে দেখবেন- আপনাদের বিলাসী জীবন যাপনের অর্থ যোগাতে গিয়ে আপনার সন্তানটি বলি দিচ্ছেন না তো?
মুনিয়ার মৃতদেহের যে কয়টি ছবি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে, তাতে মরদেহে শরীরের খোলা অংশে বেশ কিছু দাগ লক্ষ্য করা গেছে। মরদেহে জখমের চিহ্ন স্পষ্ট এবং হাতে দাঁতের চিহ্ন ছাড়াও রক্তজমাট বাধা ছিল। মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে? নাকি আত্মহত্যা করেছেন? যদি আত্মহত্যা করে থাকেন তবে কেন তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? রহস্য উন্মোচিত হোক। মুনিয়ার হত্যা অথবা আত্মহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাই।
হত্যার শিকার কিংবা আত্মহত্যার অধিকার নিয়ে কোন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে না।
মানুষ আরেকটু বাঁচুক, বাঁচার আনন্দে…