তামাক একটি সর্বগ্রাসী পণ্য। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেবন; এর সকল পর্যায়েই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন উন্নত দেশগুলো দিন দিন তামাকের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে ধূমপান কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে, তখন বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতি বছর বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন (বিসিএমএ) তামাকজাত পণ্যের কর বৃদ্ধি ঠেকাতে কিছু মিথ তুলে ধরে এবং সেই ভিত্তিহীন যুক্তিগুলো সফল করার জন্য সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালায়। তারা নীতিনির্ধারকদেরকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
তামাক কোম্পানীগুলোর দাবী করারোপের মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়লে চোরাচালান ও অবৈধ বাণিজ্য বাড়বে এবং সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। অথচ বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য খুবই সস্তা। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য মতে, বিশে^র ১৫৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কমদামে সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তায় ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য আরও সস্তা। ভারতের কম দামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কম দামি সিগারেটের মূল্যের দ্বিগুণের থেকেও বেশি। করারোপের মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়লে চোরাচালান ও অবৈধ বাণিজ্য বাড়বে, এই দাবীটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। করারোপের সাথে চোরাচালানের কোন সর্ম্পকই নেই। তাছাড়া এটি দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের, করের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
গ্লোবাল আ্যডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ সালে তাদের ফলাফলে বলেছে, ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। তার মানে প্রকৃত মূল্য ক্রমে হ্রাস পাওয়ার কারণে সিগারেটের ব্যবহার কমছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের উপর কার্যকর কর আরোপ করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ এনসিডিগুলির (non-communicable diseases) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মাধ্যমে তামাক সম্পর্কিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়েছে। তামাকের উপরে কর বাড়ানো এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি বড় কার্যকর উপায়। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের দিকেও এটি হবে একটি বড় পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম যেখানে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব) তামাক ব্যবহার করে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। বিগত কয়েক বছরে সকল পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও তামাকের দাম সেই হারে বাড়েনি। সস্তায় তামাক প্রাপ্তির কারণে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ^ব্যাংক এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে ১০% মূল্য বৃদ্ধিতে উচ্চ আয় ও নি¤œ আয়ের দেশসমূহে ধূমপান ও ধূমপানজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। মানুষের জীবনের চেয়ে কোন কিছুই বড় হতে পারেনা। তাই কার্যকর কর প্রয়োগ করে দেশকে এই ক্ষতি থেকে রক্ষা করার এখনই সময়।
বাংলাদেশে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধি করার সাথে সাথে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। এক্ষেত্রে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল করের মাধ্যমে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানো যা তাদের সাধ্যের তুলনায় কম এবং তামাকজাত দ্রব্যের উচ্চমূল্য যুবকদের তামাকের ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত করবে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদের ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করবে কারণ সস্তায় তামাক প্রাপ্তিই তামাক ব্যবহারের হার বৃদ্ধির প্রধান কারণ। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ। কারণ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০,৫৬০ কোটি টাকা, অথচ একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত হতে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২,৮১০ কোটি টাকা। তাছাড়া তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পরিবেশ ও কৃষকের জীবন-জীবিকার উপর ছিল ব্যাপক।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মাথাপিছু সিগারেট বিক্রি বিগত বছরগুলোতে যেমন ছিলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিগারেটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে প্রায় একই রকম রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে সকল তামাক পণ্যের উপর মূল্যের শতাংশ হারে (ad-valorem) সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়। এছাড়াও তামাকপণ্যের ধরণ (সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুল), বৈশিষ্ট্য (ফিল্টার ও নন-ফিল্টার) এবং ব্র্যান্ড ভেদে (সিগারেটের ৪টি মূল্যস্তর যথা- নি¤œ, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম) ভিত্তিমূল্য এবং কর হারে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া সিগারেটে বহুস্তর বিশিষ্ট করকাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা ও সহজলভ্য সিগারেট বিদ্যমান এবং ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলকভাবে কম দামি সিগারেট বেছে নিতে পারছে।
তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস করতে মুদ্রাস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি; করারোপ প্রক্রিয়া সহজ করতে তামাকজাত পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন (ফিল্টার/নন-ফিল্টার বিড়ি, সিগারেটের মূল্যস্তর, জর্দা ও গুলের আলাদা খুচরা মূল্য ইত্যাদি) দূর করে তামাকের কর ব্যবস্থাকে সহজীকরণ; সকল ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারীকে করজালের অধীনে নিয়ে আসা; পর্যায়ক্রমে সকল তামাক পণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা ও ওজন) প্যাকেট/কৌটায় বাজারজাত করা; একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদী) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখবে।
তাছাড়া, তামাকজাত পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ রফতানি শুল্ক পুনর্বহাল করতে হবে। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাসের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে যদি (১) বাজারের বেশিরভাগ অংশের সমন্বয়ে সর্বনিম্ন স্তরে সিগারেটের দাম খুব দ্রæত বৃদ্ধি করা; (২) সস্তা সিগারেটের সাথে ব্যবধান হ্রাস করতে ও পণ্যগুলির মধ্যে স্যুইচিংকে নিরুৎসাহিত করতে বিড়ির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা; এবং (৩) ধূমপানহীন তামাকের উপর করনীতি প্রয়োগের উন্নতিকরণ ও অন্যান্য কর বহির্ভূত করের ব্যবস্থাগুলি অনুসন্ধান করা যা এর প্রভাবকে প্রশস্ত করতে পারে। একই সাথে, তামাক শুল্ক সংস্কার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের অগ্রাধিকারগুলিতে অর্থের জন্য উল্লেখযোগ্য অতিরিক্ত রাজস্ব অর্জন করবে। নতুন শুল্কের সুপারিশ অর্থনৈতিক বিকাশকে আরও ব্যাপকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বোত্তম অনুশীলনের সাথে বাংলাদেশের তামাক কর নীতিকে সারিবদ্ধ করবে।
তামাক কর বৃদ্ধি করা হলে প্রায় ১১ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহী হবে এবং ৮ লক্ষাধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। দীর্ঘ মেয়াদে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং ৮ লাখ তরুণের অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আয় হবে।