১৯৭১ সালে ১৭এপ্রিলে বরিশাল শহরের পাকবাহিনী ব্যাপক বোমা বর্ষণ করলেও শহরে তারা নামেনি। পাক বাহিনীর ধারণা ছিল বরিশালে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক সংখ্যাক ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। এর কারণ অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সচিবালয় গঠন করে মুক্তিবাহিনীর সংগঠিত তৎপরতা। এর ফলে ২৫ এপ্রিল যখন পাকবাহিনী সড়কপথ ,জলপথ ও আকাশপথে একযোগে আক্রমণ চালায়। ২৪ এপ্রিল সড়ক পথে ফরিদপুর শহর পতনের পর পাকবাহিনীর বিশাল একটি ট্রুপ বরিশালের দিকে রওনা দেয়। ভুরঘাটায় এই ট্রুপ ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়। কটকস্থলে মুক্তিবাহিনীর একাংশ বাধা দিলে এখানে ৫মুক্তিবাহিনী ও বেশকিছু পাক আর্মি হতাহত হয়। এর পরেও পাক আর্মি সড়ক পথে বরিশালে পৌঁছায়। জলপথে পাক আর্মির গানবোট জুনাহারে পৌঁছাবার আগেই ২টি হেলিকপ্টার থেকে পাক আর্মি প্যারাট্রুপার নামিয়ে দেয়। তালতলি ও জুনাহারে ব্যাপক সংখ্যক পাক আর্মি সশস্ত্র অবস্থায় কভারিং করে। অন্যদিকে পাক আর্মির ৩ টি গানবোট কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী স্থানে ফায়ার করতে থাকে। নদী পথে পাক আর্মি প্রতিহত করার জন্য চরবাড়িয়ায় মহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। এসব ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, লেঃ ইমাম আল মেহেদী, হাবিলদার পঞ্চানন গাজী। ঝুনাহারের সংযোগে ইরানী ও মাজভী নামে দুটি স্টীমার নোঙর করে মুক্তিযোদ্ধারা আড়াল করে পজিশন সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। গানবোট গুলো যখন ঝুনাহার ও তালতলি অতিক্রম করেছিলো তখন শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়লে পাক গানবোট থেকে শেল বর্ষিত হতে থাকে।‘ ইরানী ও মাজভী’ এর ফলে ডুবে যায়। বরিশাল থেকে পরিস্থিতি দেখতে তৎকালণীন আওয়ামী লীগের সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর সহ মুক্তিযোদ্ধাদের জীপ নিয়ে তালতলীতে আসার মুহূর্তে পাকবাহিনী গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা কামালউদ্দিন ফিরু আহত হন। পরে আহত ফিরুকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি লাকুটিয়া জমিদারবাড়ীর ঘাটিতে চলে যায়।
পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে পিতা আবদুর রহমান ও দাদা আলী আজিম খানকে হারিয়েছেন, সে সময়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র চরবাড়িয়ার আবদুল মান্নান। তিনি জানান, তখন সকাল-১০ টা-১১ টা হবে। সকাল থেকে ২ টি হেলিকপ্টারে ছত্রীসেনা নামতে ছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানী গানবোট গুলোও বরিশালের দিকে আসতে ছিল, জুনাহারে আসলে তারা বাধা পায়, কেননা ২ টি জাহাজ দিয়ে আড়াআড়ি বাধা দেয়া হচ্ছিল। এমন সময় আগে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ সেখানে অবস্থান কর ছিল। তার এসময় ফায়ার করলে গানবোট দিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকে পাকিস্তানী আর্মিরা। একপর্যায়ে তারা তালতলীতে নেমে ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে গুলি করতে থাকে। বিকেলের দিকে তান্ডব একটু কমে আসলেও বেশ কিছু সৈন্য গানবোটে রয়ে যায়। পরের দিন তারা চরমোনাই ইউনিয়নের কায়েকটি ঘরে আগুন দেয় ও গুলি বর্ষণ করে বরিশালের দিকে চলে যায়। বরিশাল ঘাটে তাদের স্বরুপ আলী হাওলাদার সহ বেশ কিছু বাংলাদেশ বিরোধী লোকজন স্বাগত জানায়। পরের দিন মৃতদেহ মাটি চাপা দেয়া হয়। আবদুস সাত্তার হাওলাদারের বাড়িতেই ৭জন মারা যায়। তারা একটি ট্রেঞ্চে পরিবার সহ লুকিয়েছিল। ট্রেঞ্চের উপরে থেকে তাদের লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করলে একসাথে ৭ জনের মৃত্যু হয়। পরে ৭ ব্যাক্তির একটি স্মৃতি স্তম্ভ করা হয়, এ ছাড়া তালতলী বাজার সংলগ্ন নিহতের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। এ ছাড়া আমি আমার পিতা শহীদ আবদুর রহমান স্মরণে একটি পাঠাগার নির্মান করেছি। তবে এখানে যে ৪৮ জন শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারে খোজ খুব কম লোকই নিয়েছে। পাকিস্তান আর্মিদের নির্বিচারে গুলী বর্ষনে হাওলাদার পরিবার সহ অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বিভাগীয় সম্পাদক পুতুল ঘোষ জানান, এটি ছিল বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর প্রথম গণহত্যা। এরপরে পাকিস্তান আর্মি নগরীরর ওয়াপদায় তাদের সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলে বরিশালে বিভিন্ন আঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে যায়।
স্থানীয় মানুষরা জানান এই গণহত্যায় ২ বছরের শিশু থেকে ৯০ বছরের বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। গুলীতে আহতের সংখ্যা ২৫ জন, পরবর্তীতে এদের মধ্যে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছে ও বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছে। এখানে অন্তত ২ শতাধিক বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরেও নির্যাতনের শিকার এসব পরিবার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে জানান চরবাড়িয়ার সন্তান, সাংবাদিক নজরুল বিশ্বাস।
তিনি বলেন আজ ইউনিয়ন বাসীর শোকের দিন। ‘চরবাড়িয়া গণহত্যা কোনদিন ভুলবার নয়।’
চরবাড়িয়ায় শহীদের তালিকায় ৪৭ জনের নাম আছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে (১) শহীদ ইমান উদ্দিন হাওলাদার (২) শহীদ মুন্সি আজিম খান (৩) শহীদ আবদুর রহমান খান (৪) শহীদ আলী হাওলাদার (৫) শহীদ মোঃ জালাল উদ্দিন (৫) শহীদ আল বরু বেগম (৭) শহীদ রাহিমা বেগম (৮) শহীদ মোসাঃ চানবরু (৯) শহীদ বাচ্চু (১০) শহীদ মোঃ আবদুল ওহাব (১১) শহীদ পলাশ (১২) শহীদ আবুল ফজল বারী (১৩) শহীদ ময়না বিবি (১৪) শহীদ মুজাহার আলী হাওলাদার (১০) শহীদ হাসান আলী হাওলাদার (১৬) শহীদ ফজলে আলী হাওলাদার (১৭) শহীদ আবদুল ছাত্তার বাড়ী (১০) শহীদ আলফোননেছা (১৯) শহীদ আবদুল ওয়াহেদ হাওলাদার (২০) শহীদ এছাহাক হাওলাদার (২১) শহীদ রিজিয়া বেগম (২২) শহীদ হুমায়ুন রাড়ী (২৩) শহীদ মোসাঃ আঞ্জুমান নেছা (২৪) শহীদ আবদুল আজিজ হাওলাদার (২৫) শহীদ আবুল কালাম (২৬) শহীদ সেতারা বেগম (২৭) শহীদ সাফিয়া বেগম (২৮) শহীদ জবেদ আলী (২৯) শহীদ আবদুল ওয়াজেদ (৩০) শহীদ চান শরীফ (৩১) শহীদ মোঃ আবদুল বারী (৩২) শহীদ মোঃ আতাহার আলী (৩৩) শহীদ মোঃ সুলতান হাওলাদার (৩৪) শহীদ মোঃ শাজাহান মীর (৩৫) শহীদ মতলেব খান (৩৬) শহীদ নয়ন হাওলাদার (৩৭) শহীদ এ এফ এফ আলী আকবর (৩৮) শহীদ ছফুরজান বিবি (৩৯) শহীদ কাবিল খান (৪০) শহীদ আবদুর রশীদ (৪১) শহীদ মোঃ আনোয়ার হোসেন (৪২) শহীদ আবদুল মালেক গাজী (৪৩) শহীদ রকমত আলী (৪৪) শহীদ মোঃ জালাল আহমেদ (৪৫) শহীদ জামাল (৪৬) শহীদ মোতালেব (৪৭) শহীদ কাজেম আলী।