তিনি সভা কবি নন। দলীয় কিংবা বশংবদ নন। সময়ের প্রয়োজনে শব্দ আর চকিত অক্ষরে ফেটে পড়েন, নাগরিক মননে। শিরদাঁড়ার তফাৎটা শুধু দেখিয়ে দেন। শক্তি সুনীলের পর যিনি কবিতা আর অক্ষরমালা সাজিয়ে নাগরিক দায় পালন করেছেন তিনি শঙ্খ ঘোষ। বাঁচার আনন্দে আরেকটু বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোভিড এর মরণাঘাত কবিকেও বাঁচতে দিল না।
‘নিভন্ত এই চুল্লীতে মা/ একটু আগুন দে/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে’
পাঁজরে দাড়ের শব্দ যে কবি একদা শুনিয়েছিলেন। গভীর গভীরতর উচ্চারনে সমস্ত ব্যাক্তিগত যখন বিজ্ঞাপনে ভেসে যায় কবির বজ্রাঘাত উচ্চারণ- ‘বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত/ নিয়ন আলোয় পণ্য হল যা- কিছু আজ ব্যাক্তিগত।’
একদা যে কবি কীর্তনখোলা, হয়ে কালিজিরা খাল বেয়ে দেশের গ্রামে ছুটে যেতেন, সন্ধ্যা নদীর জল যার চোখের জলে একাকার, যিনি কলকাতার গৃহকোণে আরেক রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মতো ‘আবার আসিব ফিরে’র মতন বরিশালে আসতে চেয়েছিলেন ।
কবিতার ছন্দের বারান্দায় তাকে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় চকিত চাবুক ইশারায়। শব্দকে যিনি ব্রহ্ম সাজিয়ে একাই লড়ে যান।
’তুমি বললে মানবতা/ আমি বললে পাপ
বন্ধ করে দিয়েছে দেশ/ সমস্ত তার ঝাপ
তুমি বললে হিটলারিও/ জনপ্রেমে ভরা
আমি বললে গজদন্ত/ তুমি বললে ছাড়া।
জীবনানন্দ পরবর্তী কাব্যের এই তীর্যক ধার আমাদের কে আরেকবার চকিত করবে সন্দেহ নেই।
তাই ৮৯ বছরও কবি ‘শব্দহীন হও’ বলে বাক্য ছুঁড়ে দেন তখন বুঝি আমরা কিছু সময়ের জন্যও শব্দহীন হয়ে উঠি।
শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণে কবি জয় গোস্বামী মনন্তব্য করেন, ‘আমার আশ্রয় হারিয়ে গেলো। বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষটি পড়ে গেল। তিনি ছিলেন জাতির বিবেক।’
কবির শঙ্খনাদ আর বাজবে না।
আর কেউ বলবে না ‘বেশী কথা বলো কোনো?
চুপ করো / শব্দহীন হও।
কিংবা-‘যেখানে সে পা দু’খানি রেখেছে, সেখানে কাল বিকেলের শেষ ঝড়ে
পড়ে আছে কুরে খাওয়া সনাতন মহা নিম গাছ।
কবি তাই বলতে পারেন
‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/
শিকড় দিয়ে আকড়ে ধরা ছাড়া/
তোমার কোনো ধর নেই, শুধু/
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া’
সখি ভালবাসা কারে কয় তা নিয়েও ছিল কবির জীবনভর বিস্ময়-
‘মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে
আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক
ভালোবাসা বলে।’
ভালোবাসার উষর পথ- কবিকে কে কোন গন্তব্যে নিয়ে যায়নি। শুধু বাঁচাবার আনন্দে কবি বাঁচতে চেয়েছিলেন শুধু। আর কিছু নয়।