কবর খোঁড়ার কাজটা এতকাল আজম আলী পুণ্যের কাজ জেনে খুব ভালোবেসে করে আসছিল। প্রায় পনেরো বছর ধরে সে আজিমপুর গোরস্থানে এই কাজ করে। ছোটবেলায় বাপ মারা যাওয়ার পর থেকে নানার কাছে থাকে আজম। নানার হাত ধরেই সেই পনেরো,ষোল বছর বয়স থেকে এই কাজ করে আসছে সে। নানা গতবছরের শুরুতেই করোনায় মারা গেল। যে নানা সারা জীবন মানুষের দাফন কাফনের কাজ করেছে খুব যত্নের সাথে, মৃত মানুষটারে কখনও মৃত ভেবে ধরেনি। কবরে যখন শুয়ে দিয়েছে তখনও এমনভাবে নামিয়েছে যেন তার ব্যথা না লাগে। সে যেন কষ্ট না পায়। সেই নানারে আজম একলা কবর দিছে। গোছল দেওয়ায় নাই। হাসপাতাল থেকে যেমন প্যাকেট করে দিছে তেমন প্যাকেট করেই কবরে শোয়াইয়া দিছে।
তারপর এই একটা বছর নিজে যেন একটা খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। দিন-রাত লাশ আসে, কবর দেয়, পরনের প্যাকেট খোলার অবসর পায় না প্রায় দিন। বাড়িতে যায় না। মা আছে,বউ আছে, একটা ছেলে আছে। এই গোরস্থানেই মাঝে মধ্যে একটু ঘুমায়। প্রায় দিন খেতে পারে না। খাবার নিয়ে বসে, কিন্তু গলা দিয়ে নামে না। যদিও বা একটু ঘুম ধরে,চোখ লেগে আসতে না আসতেই লাশ এসে হাজির। এমন হয় একসাথে আট,দশটা লাশ আসে,তাদের এক কবরেই নামিয়ে দিতে হয়। আজমের সাথে আর যারা আছে সকলের অবস্থাই একরকম।কেমন পাগল পাগল লাগে। গোরস্থানে একসাথে কাজ করত তাদের মধ্যেও কয়েকজনকে নানার মতো কবরে শোয়াতে হয়েছে। নতুন যারা আসছে এই কাজে তাদের অনেকেই দু’দিন যেতে না যেতেই কাজ ছেড়ে চলে যায়। কেউ কেউ দুটো বেশি টাকা রোজগারের আশায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। আজকাল মাটি খুঁড়লেই লাশের গন্ধ ছড়ায়।এক লাশ মাটিতে মিশে যাওয়ার আগেই সেখানে আর এক লাশ রাখতে হয়। বেশিরভাগ সময় লাশের সাথে আপনজন থাকে না। সরকার না-কী লোক ঠিক করে দিছে,তারাই লাশ নিয়া গোরস্থানে আসে। দুই একজনের সাথে এক-আধজন আপনজন আসে।কী কপাল! কবরে মাটি দেওয়া, দোয়া দরুদ পড়া সবই করে সরকারের লোকেরা।
আজম বুঝতে পারছে না সে আর কতদিন এখানে কাজ করতে পারবে? বউ, ছেলে, মায়ের সাথে দেখা করতেও যেতে পারে না। মহল্লার লোকেরা তারে ঢুকতে দেয় না। আগে গোরস্থানে রাতের বেলা অনেকের দেখা পাওয়া যেত, বাসায় না যাইতে পারলেও সমস্যা হতো না। এখন কেউ আসে না। তারা যেন এই গোরস্থানেই নির্বাসনে আছে।
সবাই মিলে নেশা করে, নেশার ঘোরে কখনও কাঁদে, কখনও হাসে, আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও করে। কিন্তু শেষ হয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কবর খোঁড়া, কবরে মাটি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আজ কম করে হলেও ত্রিশটা লাশ দাফন করেছে, নারী পুরুষ মিলিয়ে। এখন তো আর প্যাকেট খোলা হয় না, তাই নারী পুরুষ আলাদা করা হয় না। হ্যাঁ প্যাকেটের গায়ে নম্বর আর নাম, ঠিকানা থাকে। কিন্তু এত লাশ দাফন করতে গিয়া মাথা ঠিক থাকে না। তাই নম্বর ধরে কবরে শোয়াইয়া দেওয়াটাই বড়ো কথা। এই নম্বরেই এখন সবার পরিচয়।ধনী, গরিব, বৃদ্ধ, যুবক, নারী, পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নাই। অলিখিত সাম্যের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। আজ দুপুরে একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবকের লাশ এসেছিল। প্যাকেটের গায়ে বয়সটাও লেখা থাকে। আজম লাশ নামানোর পরে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে নিজের কথা ভাবতে শুরু করে। এতকাল ধরে এত মানুষের কবর দিলাম, আমার কবরে মাটি দেওয়ার কেউ থাকবে তো! না-কি আমিই হব শেষ মানুষ যার কবর দেওয়ার জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না! এক-একবার মনে করে কাজ ছেড়ে দেবে, কিন্তু এই গোরস্থান ছেড়ে তো সে কোথাও গিয়ে থাকতেও পারবে না আজম আলী।