‘একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়’- রউফুল আলম
দেশপ্রেমে উজ্জীবিত লেখক রউফুল আলম এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়’- বইটির মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষা, গবেষণা ও তারুণ্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ অত্যন্ত সহজ-সরল এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে দিকনির্দেশনা মূলক লেখায় তুলে ধরেছেন ৬৩ টি প্রবন্ধের আলোকে। প্রবন্ধগুলো আকারে ছোট কিন্তু তথ্যে সমৃদ্ধ।
লেখক শুরুতেই বলেছেন চীনাদের কথা৷ গোটা দুনিয়া থেকে যে জাতিটা শিখতেছে সেটার নাম চীন। তাদের অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য। সে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শত্রুটির নাম জাপান। অথচ জাপানেও গবেষণা করছে চীনের অনেক শিক্ষার্থী। সারা বিশ্ব থেকে ওরা জ্ঞান ধার করছে। চীন শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ তরুণ আমেরিকায় পাঠায় গবেষনার জন্য ৷যেটাকে তারা বলে ‘Intellectual Scanning’ এবং পরবর্তীতে তারা ঐ সমস্ত মেধাবীদের ‘Thousand Talent Plan’ প্রকল্পের মাধ্যমে আবার দেশে ফিরিয়ে আনে।
কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের পেছনে ৷ তরুণেরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণা করতে থাকেন ৷ এমন একটি প্রকল্প কুড়ি বছর চালু থাকলে কুড়ি হাজার গবেষক তৈরি হয়ে যায় ৷ কি দূরদর্শী এবং টেকসই পরিকল্পনা তাদের! অথচ আমরা কিনি যুদ্ধ জাহাজ! যে দেশ তার কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের ভালো রাখার চেষ্টা করে, তাদের দুঃখ কান পেতে শোনে, সে দেশটা নীরোগ থাকে। সে দেশ রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে সহস্র কোটি টাকার অস্ত্র কিনতে হয় না। প্রতিটি তরুণ প্রতিরক্ষার একেকটি বারুদ হয়ে যায়।
জাতীয় নির্বাচনের দিনেও আমেরিকানরা কাজ করে৷ কাজের জন্য তাদের দরজা বন্ধ হয় না কখনও ৷একটা দেশের শিক্ষক,গবেষক, তরুণেরা যদি এক মিনিট ভালো কাজে মাথা খাটান, সে সময়টা দেশের সম্পদে পরিণত হয় ৷ সেটা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হয় ৷ এই বিষয়টা বোঝার মতো জ্ঞান পৃথিবীর সব সমাজের হয়নি, বিশেষ করে আমাদের। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের জন্মদিন ৪ এপ্রিল। আমেরিকায় এদিনটি President Day হিসেবে উৎযাপিত হয়। লেখকের প্রফেসর প্রেসিডেন্ট ডে’ তে কাজ করতে চলে এসেছেন অফিসে।
তাঁকে দেখে লেখক বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে বলেছিলেন, ‘তুমি আজও কাজ করতে চলে এলে? President Day তে বিশ্রাম করতে পারতে। ‘প্রফেসর উত্তর দিয়েছিলেন, Washington did his job. I must do my job. His life and work won’t make me great. এই হলো ওদের দৃষ্টিভঙ্গি। লেখক অনেকটা আক্ষেপের সাথে বলেছেন, আমেরিকান সমাজে President Day বা স্বাধীনতা দিবসেও মানুষ কাজ করে অথচ আমাদের দেশে ১৫ আগষ্টে একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার জন্য তাকে নিগৃহীত হতে হয় ৷ শোক দিবস কি জ্ঞান চর্চার জন্য নিষিদ্ধ? প্রকৃত অর্থে জ্ঞানচর্চার জন্য আসলে কোন দিবসই বাধা নয়। কিন্তু একথাটি ভাববে কে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের অর্থাভাবে যে টিউশনি করে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় নষ্ট করে সে বিষয়েও লেখক অবতারণা করেছেন ৷ অথচ রাষ্ট্র যদি ঐ সমস্ত ছাত্রদের সময়কে কাজে লাগাতে পারত অথবা কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারত তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে যেত স্বমহিমায় ৷ লেখক মনে করেন চাকরিতে কোটা থাকা উচিত প্রতিবন্ধী এবং হিজরাদের জন্য ৷যে সমাজে নানুষ জন্মের কারণে বঞ্চিত হয় সেখানে প্রকৃতির অভিশাপ নেমে আসে ৷ কারণ যোগ্য ব্যক্তিরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হলে সেখানে তাঁদের ভেতর কর্মস্পৃহা হ্রাস পায়, দেশ এবং সমাজের নেট প্রোডাক্টিভিটি কমে যায় ৷আমাদের রাষ্ট্র শক্ত ভিতের উপর না দাঁড়ানোর অন্যতম কারণগুলোর মাঝে এটা একটা।
লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কে নানাভাবে অবহেলায় রাখা হয়েছে ৷ যে সমাজ তার সম্ভাবনাকে মূল্যায়ন না করে পায়ে ঠেলে, অবহেলা করে সে সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত হয় নানাভাবে। কারণ উত্তম বীজতলায় খারাপ বীজও ভালো গাছ দেয় পক্ষান্তরে উষর বীজ তলায় ভালো বীজও নষ্ট হয় ৷লেখক ইউজিসির চেয়ারম্যান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের প্রতি অনুরোধ করেছেন অন্ধ দলবাজি না করে ছাত্রদের সমস্যার দিকে মনোযোগ দিতে, তাদের সমস্যা ও সম্ভবনা নিয়ে দু’কলম লিখতে।
দুনিয়ার কোনো সভ্য – শিক্ষিত দেশে এখন পিএইচডি ও পোস্টডক ছাড়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়া যায় না ৷অথচ আমাদের দেশে সেটা সম্ভব। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম করার অর্থ হলো শত শত ছেলেমেয়েকে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা ৷ দুনিয়ার সব কিছু তৈরি করে মেধাবীরা আর মেধাবীদের তৈরি করেন শিক্ষকেরা, তাই যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে সব থেকে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ বিষয়ে আপোষহীন সংস্কৃতির প্রতি লেখক সর্বাপেক্ষা গুরুত্বারোপ করেছেন।
লেখকের একবার স্বশরীরে নোবেল প্রাইজ অনুষ্ঠান দেখার বিরল সুযোগ হয়েছিলো, সেখানে তিনি দেখেন নোবেল প্রাইজ অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ীরা সবার শেষে হলে ঢোকেন। যখন নোবলে বিজয়ীরা হলে ঢোকেন, তখন তাদেরকে সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। এমনকি সুইডিশ রাজ পরিবারের রাজা ও অন্যান্য সকল সদস্যরাও। কারন নোবেল বিজয়ীরা হচ্ছেন জগতের রাজা। যে জাতি যেটির মূল্যায়ন করে, সে জাতি সেটিই পায়। আমরা দেশ ভর্তি নেতা পেয়েছি, নেতায় নেতাচ্ছন্ন এক দেশ। আর পশ্চিমা দেশগুলো পেয়েছে পৃথিবী বদলে দেয়া মানুষ। সেখানকার দেশগুলো আমাদের মতো নেতায় আচ্ছন্ন নয় তবে যোগ্য নেতার সংকট হয়না কখনও।
আমরা সমগ্র দুনিয়া থেকে কতকিছুই না ধার করি, খাবার সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, যুদ্ধাস্ত্র আরও কত কি! কিন্তু সারা দুনিয়ার শিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতিটা কেন যে আমরা ধার করি না, অনুসরণ করি না সেটা আজও বুঝিনা। অথচ আমরা ইচ্ছা করলেই সেটা ধার করতে পারতাম, কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই বোধটা আজও আমাদের মাঝে জাগ্রত হলো না।