বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি রাস্তার জমে থাকা পানি ছিটকে ছড়াচ্ছে দুদিকে অমানবিকভাবে। মনে হচ্ছিল বেবি টেক্সির ড্রাইভার কে বলি আপনি কি মানুষ? এত জোরে চালানোর কি দরকার? হেঁটে চলা মানুষদের গায়ে ছিটে পরছে কাদা পানি, আমার তো যথেষ্ট সময় আছে আমার প্লেন ছাড়বে বেলা তিনটায়। বলে লাভ নাই, জোরে চলছে এখন বাজে মাত্র দেড়টা।
বেবি টেক্সি মনে হয় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, পেট্রোলের গন্ধ মন্দ লাগে না নেশা ছড়ানো যেন, ছিটকে ছিটকে ঝিরিঝিরি বাতাসের সাথে বৃষ্টির কনা আসছে আমার নাকে মুখে। বিরক্ত উড়ে যাচ্ছে স্বপ্নময় একটি প্লেন ভ্রমণের জন্য। এখন বাংলা কি মাস বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। চিৎকার করে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ও ভাই জানেন এটা বাংলা কি মাস? সে বলল বৈশাখ মাসের চার তারিখ আইজ। আমরা যারা আধা শিক্ষিত মানুষ কিন্তু আমরা বাংলার কথা বলি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বলি, ভাষা শহীদদের কথা, আন্দোলন ও ত্যাগের কথা বলি অথচ বাংলা মাসের খবর রাখি না।
তেজগাঁও এয়ারপোর্টে আসলাম নামটা ঢাকা এয়ারপোর্ট ইংরেজিতে Dacca International Airport বাংলায় লেখা ঢাকা এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের মুখে এসে থেমে গেল বেবি ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে মাঝারি সাইজের রেক্সিনের ব্যাগটিকে কাঁধে নিয়ে নেমে আসলাম এয়ারপোর্টের ভিতর। এয়ারপোর্টের ভিতরে মাথার উপরে বন বন করে ঘুরছে অনেকগুলি পাখা মনে হয় যেন বাতাসের ঝড় খেলা করছে।
রাশিয়ান এয়ারলাইনের এরুফলতের কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন বাঙালি ভদ্রলোক পাশে ভিশন ফর্সা আর ঠোঁটে লাল টকটকে লিপিষ্টিক দেওয়া একটি রাশিয়ান মেয়ে দুজনেরই কালো স্যুট টাই পরা আমি পাসপোর্ট ও টিকেট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মস্কো যাওয়ার প্লেন কখন ছাড়বে তিনটায় তো? আমি প্যাসেঞ্জার। তারা আমাকে বললেন লেটে যাবে অপেক্ষা করুন। কি যেন একটা রহস্যময়তা ওদের মুখমন্ডলে যেন কিছু একটা আমাকে লুকিয়েছে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বেঞ্চের মত কতগুলি চেয়ার সাজানো একটিতে বসলাম ডানদিকের চেয়ারটি খালি। আমার সামনে বরাবর একটি এস্ট্রে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে এক পায়ে যেন, আমাকে বলছে তুমি তাড়াতাড়ি সিগারেট ধরাও আমার ভিতরে সিগারেটের ছাই ঝাড় আমি ক্ষুধার্ত।
এয়ারপোর্টে রওনা হওয়ার সময় বেবিট্যাক্সির ভাড়া ঠিক করে দাঁড় করিয়ে রেখে দুই প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট কিনে নিয়েছিলাম, আর কিনেছিলাম দুইটা দিয়াশলাই যাকে বলে ম্যাচ। আয়েশ করে বসে একদম নতুন প্যাকেটে ভালো করে দেখে হাতিয়ে মজাটা নিয়ে লাল চিহ্ন রেখা যুক্ত সলোফিনের প্যাকেটা খুলে অর্ধেকটা সেলফিন পেকেটে হাফ প্যান্টের মত রাখলাম, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকে চিমটি দিয়ে একটা সিগারেট তুললাম। আহা যা মজা লাগছে মনে হচ্ছে যেন আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ভদ্রলোক মানুষ।
কারণ, কখনো একসাথে এক প্যাকেট সিগারেট সচরাচর কিনা হয়নি। কেমন জানি মজা মজা মজা ভাব আর নিজেকে স্বাধীন স্বাধীন লাগছে আশপাশে এমন কেউ নেই যে সম্মান দেখাতে আমার সিগারেট লুকাতে হবে। সিগারেটটা যেন বলছে আমাকে জ্বালাও এখনেই! কি আর করা পকেটে ছিল ঘোড়া মার্কা দেয়াশলাই নামের ম্যাচ দুইটা কিন্তু, দেখি বৃষ্টির ছিটা পড়ে ভিজে আছে চারপাশটা দেশলাই কাঠি দিয়ে চেষ্টা করলাম বারবার আগুন জ্বালাতে কিন্তু আগুন জলে না বিরক্তকর অবস্থার মধ্যে পরলাম আমি। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ যেন ফাঁকা ফাঁকা কিছু মানুষ ঐ সামনের দিকে।
আমি যেখানটায় বসেছি তার বাঁ পাশে বেশ কয়েকটি নানান জিনিসপত্রের সাজানো-গোছানো দোকান । উঠে গেলাম ব্যাগটি রেখে একটি দোকানে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম আমারে একটা ম্যাচ দিন সে বলল এখানে ম্যাচ বিক্রি করা নিষেধ। বললাম তাহলে! আমি সিগারেট ধরাবো কেমনে! সে বলে আপনি একটা লাইটার কিনে নিন দাম বললো দশ টাকা অথচ বাইরে বড়জোর সেটা পাঁচ টাকা আর তিন ঘোড়া মার্কা ম্যাচ পাওয়া যায় টাকায় দুইটা।
মনের দুঃখ নিয়েই কিনলাম আর নিজেকে অনেক বড়লোক ভাবলাম। অনেকক্ষণ যাবৎ প্রসাব করা হয় না ভিশন খারাপ লাগছে কিন্তু আমি ব্যাগটা সাথে আনব ! বাথরুমের ফ্লোরে যদি পানি টানি থাকে তাহলে ব্যাগের তলা ভিজে যাবে ময়লা পানিতে। পুরনো এয়ারপোর্ট। আরও শুনেছি আজকেই লাস্ট ফ্লাইট যাবে তারপর খুলে যাবে নতুন এয়ারপোর্ট আর এটি হয়ে যাবে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট এর আগে ঠিকঠাক করবে আরো সুন্দর করবে আর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট চলে যাবে কুর্মিটোলা সেটি হবে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এ জন্য মন খারাপ দোকানদারকে বললাম ভাই ঐ যে দেখা যায় চেয়ারে রাখা আমার ব্যাগটি একটু খেয়াল করবেন আমি একটু বাথরুমে যাব খুব তাড়াতাড়ি আসবো দেখবেন ভাই। সিগারেট না ধরিয়ে চলে গেলাম বাথরুমে যা ভাবছিলাম তাই যত্নহীন ভাবে বাথরুমটার অবস্থা।
বাথরুম থেকে ফিরে দেখি আমার ডানদিকের খালি চেয়ারটিতে একটি মেয়ে বসে আছে মেয়েটিকে কেমন কেমন কালো কালো চেহারার মনে হচ্ছে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি আমার মতো করে এসে আমার চেয়ারে বসলাম বসে সিগারেটটা ধরালাম মনে হল যে আমি একজন বিগ বস লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরানো সোজা কথা! সারা শরীর মনে একটা ভাব উঠে গেল আয়েশ করে টান দিলাম ধোঁয়া ছাড়লাম।
পাশের মেয়েটি আমাকে এক্সকিউজ বলে আপনি কি সিগারেট নিয়ে একটু দূরে যাবেন কথাটি ইংরেজিতে বলল। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম ওকে নো প্রবলেম প্লিজ লুক আফটার মাই লাগেজ। সে বললো নো প্রবলেম আই উইল ডু দ্যাট। দূরে গিয়ে সিগারেট টানছি আর দেখলাম আমার এদিকে তাকিয়ে সে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে মনে মনে বললাম একটা অভদ্র মেয়ে তুই আমার সাথে বসতে আসলি কেন? অনেক চেয়ার তো খালি ছিল অন্যখানে বসতি তাহলে তো আর সিগারেটের গন্ধ তোর নাকে লাগতো না, ধোঁয়া উড়ে যেত না তোর নাকে মুখে, ফাজিল মেয়ে আবার ইংরেজিতে কথা কস “বাঙালি কুত্তা ইশকারী রাও”।
যাহোক আমার মত আমি সিগারেটি ঠোঁটে সাইট করে ভাব ধরে ইচ্ছামত টানলাম মনটা মধ্যে একটা বস বস ভাব নিয়ে। সিগারেট শেষ। ভাবটাও কেমন জানি যেন উধাও হয়ে গেল। আবার আমি আমার চেয়ারে বসলাম। আসার সময় ওর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম নাহ্ মেয়ে টি হয়তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হবে কিন্তু তাহলে তো ফর্সা হত একটা ব্রিটিশ ব্রিটিশ ভাবসাব থাকত। এত কালচে শ্যামলা মানুষ। কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করলাম না দরকার কি? অপরিচিত জনকে জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা।
ভাবছি মেয়েটি হয়তো ঢাকা কোন দূতাবাসে বা বিদেশি এনজিওতে চাকরি করে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির নিজ থেকে বলে উঠলো মে আই নো হয়ার ইউ আর গোয়িং? আমি বললাম আমি মস্কো যাব। কথা হচ্ছে ইংরেজিতে আমি বললাম আমি মস্কো যাব আপাতত, তারপরে হেলসিংকি। মেয়েটি নিজ থেকে বলল আমি আমি মস্কো হয়ে স্টকহোম। আজ সকালে ক্যালকাটা থেকে এসেছি ঢাকা।
সকাল থেকে এ পর্যন্ত এয়ারপোর্টে দুপুরে রাশিয়ান এয়ারলাইন খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু চা-কফি কিনে কিনে খাচ্ছি। ক্যালকাটা থেকে আসা মোট ৬০ জন প্যাসেঞ্জার সবাই ওই দিকটায় বসা। এত চিৎকার কথাবার্তা আমার ভালো লাগছিল না তাই এখানে আসছি বসতে। আমি বললাম কেন কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট মস্কো ফ্লাইট নেই? ছিল।
কিন্তু, প্লেনের সমস্যা হওয়াতে ঢাকাতে ল্যান্ড করেছে কিন্তু, বুঝলাম না কেন ঢাকা! করাচিতে তো ল্যান্ড করার কথা। করাচিতে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। আপনার প্লেন হয়তো আসবে না ক্যালকাটা থেকে আসা প্লেনেই তুলে দিবে ঢাকার প্যাসেঞ্জার। ভাবতে পারছিনা, জানিনা! কখন আবার ঢাকা ছেড়ে মস্কো আমাদের নিয়ে রওনা হবে। ঐ দেখা যায় উড়োজাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমাদের ডাকছে না। একদমে ভারতীয় স্টাইলে ইংরেজিতে কথাগুলি বলে আমার দিকে তাকালো তাকানোতে মনে হল ওর টানা চোখে একটা ঝিলিক আছে যা আমার চোখে পরলো।