নববর্ষের সেকাল একাল
নববর্ষের দিনে চিত্ত আজি
আনন্দ আর সুন্দরে
নবশ্যাম রূপে- সঙ্গীতের এক গভীর নিভৃতে
স্ফুলিঙ্গের ঝলকানো সাজে বিষণ্ণতার মাঝে
বার্তাবহ রূপে-
সে এক নতুন উদ্যমে…
নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিনে আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করে, বর্তমানের মূল্যায়ন ঘটায়। আগামী জাতির রূপরেখাটির দিক নির্দেশনা দেয়। এ কারণেই বাংলা নববর্ষ আমাদের গৌরব, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। সুতরাং বাংলা নববর্ষ সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশের এক সাংস্কৃতিক অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক রূপ ফুটে উঠছে। যার পেছনে থাকে সকল দুঃখ বেদনা ভুলে পুরাতনকে বিদায় এবং নতুনকে স্বাগত জানিয়ে জীবন শুরুর দিন। যেখানে পালিত হয়- হালখাতা, পূণ্যাহ, বৈশাখী মেলা।
আমাদের সবচেয়ে বড় গণমুখী উৎসব বাংলা নববর্ষ । আমরা জানি এই নতুন দিনে আগামী সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাই তো মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয় এবং নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতিতে মেতে ওঠে। চিরচেনা অতি আপন ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে, শহরে বন্দরে মহানন্দে মাতোয়ারা হয় প্রতিটি মানুষ। সাফল্য ও সমৃদ্ধির আলোক ধারায় বিভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠে এই উৎসব। অজান্তে হৃদয় তন্ত্রীতে বেজে ওঠে ভালবাসার সুর।
রবীন্দ্রনাথের সেই হৃদয় স্পর্শী গান-
‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি, শুষ্ক করি দাও আসি।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক দূরে, যাক যাক যাক।
এসো এসো…
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’
নববর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে লক্ষ্য করা যায়, এই উপমহাদেশে মুসলিম শাসকগণ সর্বপ্রথম হিজরি সন প্রবতন করেন। মোগল সম্রাট আকবর যেদিন সিংহাসনে আরোহণ করেন, সেদিন দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলা সনের উৎপত্তির কথা শোনা যায়। বাংলা সনের মূল স্রষ্টা ফতেহউল্লাহ সিরাজী।
উৎপত্তির সময় থেকেই এদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের চাষাবাদ, খাজনা পরিশোধ, বছরের হিসেব নিকেশ, বিয়ের তারিখ বাংলাপঞ্জি অনুসারে করা হতো।
ব্যবসায়ীরা নতুন হালখাতা শুরু করে নববর্ষের প্রথম দিন থেকে। হালখাতা নববর্ষের একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান আচরণীয় রীতি। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, এদিনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে জাঁকজমক ভাবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ধুয়ে মুছে বিভিন্ন সাজে সাজিয়ে তোলা হতো এবং প্রত্যেককে আমন্ত্রণ করে অতীত হিসাব শেষ করে নতুন খাতা ব্যবহার করে এসব আচার অনুষ্ঠান করা হতো। এ সময়ে নানা রকমের মিষ্টি থাকতো, প্রত্যেককে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষকে আপ্যায়নে আনন্দে অংশীদার হতেন।
অর্থাৎ সম্প্রীতির এক মেইল বন্ধনে আবদ্ধ হয় দেশের কাজে একসাথে থাকার অঙ্গীকার ফুটে উঠতো, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এই জাঁকজমক অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে বিলিপ্ত হতে হতে থাকে- যা আজও দৃশ্যমান। বাংলা নববর্ষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা হলও পূণ্যাহ। পুণ্যাহ শব্দের মৌলিক অর্থ পুণ্য কাজ অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুমোদিত প্রশস্ত দিন। কিন্তু বাংলায় এ অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের দিন।
নববর্ষের সাথে বাংলার অর্থনৈতিক যোগসূত্রটি সুপ্রাচীন। তাই তো বৈশাখ মাসটি বাংলা সনের সূচনা মাস হিসেবে গণ্য ছিল না। তখন প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। সেন আমলের অবসানের পর মুসলিম শাসনামলের বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষিজাত পণ্যের প্রাচুর্যের কারণেই বৈশাখ মাসটি বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গৌরবের অধিষ্ঠিত হয়।
বাংলার সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ইংরেজি বর্ষের দিনক্ষণ মেনে চলতে হয়। তবুও বাঙালির ঐতিহ্যের শেকড়ে গ্রথিত বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ আমাদের জীবনাচার। কম্পিউটার ইন্টারনেটের যুগেও আমরা সকল মহল সাড়ম্বরে নববর্ষ পালন করি।
প্রকৃতিতে এই সময়ে থাকে মৌসুমি ফলমূলে ভর্তি। নানা রকম কুটির শিল্পজাত দ্রব্য, মৃৎশিল্পে, কাঠ, বাঁশ ও বেতের তৈরি প্রয়োজনীয় জিনিষ- খেলনা হাতি, ঘোড়া, ভেঁপু, মুখোশ, ঢাকঢোল, মুড়ি মুড়কি বাতাসা কেনার ধুম পরে যায়। শিশুদের নাগরদোলা, পুতুল নাচ, চরকা সহ নানা গ্রাম্য মানুষের সৃষ্টিশীল শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে নানা বয়সের মানুষকে উৎসাহ দেয়। এছাড়াও শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঢাকা রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে জনতার ঢল। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না, কিভাবে জঙ্গি তৎপরতার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার সবক হাতে নিয়ে গ্রেনেড হামলা করেছিল! সে দৃশ্য আজওও যেমন আতঙ্কিত তেমনি মনে হয় আমরা এই অবস্থান থেকে পুরোপুরোভাবে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখনও তারা দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যভাবেও অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে নগর জীবন ও নগর সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে নববর্ষের উৎসবের সূচনা হয়। শিল্পীরা সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করে। আমরা নতুন পোশাক বিশেষ করে নারীরা সাদা শাড়ি লাল পেড়ে, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা, কপালে টিপ, পুরুষেরা পাঞ্জাবি, পায়জামা, ধূতি পরে, বাঙালি সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য তার বহিরপ্রকাশ ঘটায়।
বাংলা নববর্ষে উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব বইসাবী’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। নানা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, নানা ধর্মের ঐতিহ্য পূর্ণ অনুষ্ঠান হলও আম্মাদের নববর্ষ। বসন্ত ঋতুর শেষে নতুন বছরের আগমনী সময়ে আমাদের দেশের স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়ায় দোয়েল, কোয়েল, বউকথা কও পাখির গানে মরুময় জীবনে আনন্দের বান দেকে যায়। আর এখানে মানুষের মধ্যে নতুন আবেগ জাগিয়ে তোলে।
তারপরেও, গত বছরে করোনা সংক্রমণের কারণে আমরা সম্মিলিতভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী উৎসব পালন করতে পারিনি। আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করছি, সবচেয়ে খারাপ সময় আমরা অতিবাহিত করছি। কামনা করি ১৪২৮ বঙ্গাব্দ সবার ভাল কাটুক। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে জীবন যাপন করুক। আমাদের সর্বজনীন উৎসবের অভিজাত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় রক্তিম উচ্ছ্বাসে সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি মূর্ত হয়ে উঠুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশাখী ভাতা প্রচলন করেছেন। আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। তিনি পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য কত যে ব্যপ্তি- সকল ক্ষেত্রে তা অনুধাবণ করেছেন। আমরা আশা করি আগামী বছর ১৪২৮ বঙ্গাব্দ বিশ্বে নতুন সম্ভাবনা দ্বার খুলে দেবে। দুঃখ কষ্ট একঘেয়েমি অবসাদ, রোগ শোক দূরীভূত করে ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে মহাকল্যাণ সাধন করবে। এটাই হোক নববর্ষের সকল মানুষের ঐকান্তিক প্রত্যাশা। সুস্থ থাকি, সুস্থ রাখি।