আমাদের রাজনীতি থেকে সংঘাত দূর হতে পারে যদি সাময়িক সমাধানের পথে না গিয়ে বৈরিতা/সংঘাতের মুল উপাদানগুলোকে আমরা নির্মূল করতে পারি। বর্তমান সংকটের সমাধান হবার খুব ক্ষীণ যে একটা সম্ভাবনা আছে সেটা হলো নির্বাচনের সংকট নিয়ে আলোচনা আপাতত স্থগিত রেখে আওয়ামীলীগ-বিএনপির মধ্যে বৈরিতা, অবিশ্বাস ও চেতনাগত পার্থক্য দূর করার চেষ্টা করা। আগেই বলেছি কাজটা কঠিন বা অসম্ভবের কাছাকাছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে ভিক্তর মাৎসুলেনকো তার বই দ্য হিস্ট্রি অব সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার বইয়ে লিখেছিলেন, “ঐ পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান ছিল আর একটা বড় যুদ্ধ যা কমপক্ষে ইউরোপ-এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটাবে এবং মহাদেশগুলোর ক্ষতগুলোকে সারাবে।” স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার করে আমরাও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সেরকম একটা পরিস্থিতির মুখে হাজির হয়েছি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে শুনতে খারাপ লাগলেও এটা হয়তো খুব যৌক্তিক অনুমান যে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের মধ্যে দিয়ে শেষ হতে পারে। প্রায় অর্থহীন একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামীর সাথে সরকারের সংঘর্ষ সেরকম কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। হেফাজতে ইসলামী ধর্ম রক্ষার আন্দোলন করছে বলে দাবি করলেও তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক সেটা এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সাংগঠনিকভাবে আনুষ্ঠানিক সমর্থন না জানালেও এই দুই দলের নেতা-কর্মীরা হেফাজতের আন্দোলনের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে মাঠে আছে। হেফাজতের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও এই অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটবে না। আবারও নতুন কোন ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হবে — যার আসল লক্ষ্য সরকারের পতন ঘটানো।
আমরা জানি যে এই সংকটটা তৈরি হয়েছে মূলত নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়াকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এই সময়কালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়নি। আইনগত সমস্যা যদি নাও থেকে থাকে, এই নির্বাচনগুলোতে নৈতিকতার সংকট আছে। সরকারের বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ মানুষের মন ভরাতে পারছে না। বিষয়টা অনেকটা এরকম যে নির্মিত হবার আগেই যদি পদ্মা সেতু ভেঙে পড়ে অথবা ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলো মান রক্ষা করতে না পারার কারণে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে জনগণের একটা বড় অংশ খুশি (বা উল্লসিত!) হবে।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হবার দায় আওয়ামীলীগ যুক্তি বা অপযুক্তি দিয়ে বিরোধী দলগুলো, বিশেষত বিএনপির কাঁধে চাপাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। পঞ্চাশ ভাগ দায় যদি বিএনপির হয় বাঁকি পঞ্চাশ ভাগ আওয়ামীলীগকে নিতে হবে! প্রধানমন্ত্রী নিজেও সেটাকে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলেছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬-র নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন একই ধারার ছিল। সেসময় আন্দোলনের মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল নির্বাচনটি নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয় বলে। বিএনপি ইচ্ছা করলে পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে যেতে পারতো। সাংবিধানিকভাবে বৈধ ছিল বলেই তারা সংসদে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করেছিল। একই রকম নৈতিকতার সংকট নিয়ে নির্বাচিত হয়ে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা ছাড়েনি। আওয়ামীলীগের দাবি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে মাঠে নামা থেকে বিরত থেকেছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এই দাবি হয়তো সত্য।
বিভিন্ন সূত্রে এরকম জানা যায় যে ২০১৮-র নির্বাচনে আওয়ামীলীগের লক্ষ্য ছিল বিএনপিকে ৭০-৯০ আসনের বিরোধী দল হিসেবে সংসদে নিয়ে আসা। ২০১৮-র জুন মাসে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির কয়েকজন নেতা দিল্লী সফরের সময় ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যস্থতায় আওয়ামীলীগের সাথে এই সমঝোতায় পৌঁছান যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং পরবর্তী পাঁচ বছর দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে এই শর্তে যে ২০২২ সালের নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক বা অস্থায়ী কোন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। সমঝোতা অনুযায়ী বিএনপি নির্বাচনে ছিল।
কিন্তু আওয়ামীলীগকে ফাঁদে ফেলার সুযোগটিও বিএনপি হাতছাড়া করেনি। নির্বাচনের দিন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোন নেতা-কর্মী ছিলেন না। তাদের মহাসচিব ঠাকুরগাঁয়ে বসে প্রথম প্রহরে নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু বলে গণমাধ্যমের কাছে বললেন। নির্বাচন শেষ হবার দুই ঘণ্টা আগে সাংবাদিকরা তাকে বিভিন্ন আসনে বিএনপির প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার খবর জানালে তিনি বলেছিলেন, “সেটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমরা (বিএনপি) নির্বাচনে আছি।” দিল্লীতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিএনপি নির্বাচনে থাকার শর্ত পূরণ করেছে। তবে তাদের অন্য একটা লক্ষ্য ছিল — নির্বাচনের মাঠ এমনভাবে ফাঁকা করে দেওয়া যাতে অবারিত রিগিং এর মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সবগুলো আসন জিতে নেয় এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাদের পরিকল্পনা শতভাগ সফল হয়েছে এবং আওয়ামীলীগের চালাকি বিএনপির অতি চালাকির কাছে মার খেয়ে গেছে।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। একটা সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে চলমান সংকটের একটা আপাত সমাধান হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৪ টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে; যেগুলোতে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি দুইবার করে ক্ষমতায় এসেছে। অতি রাজনৈতিক অভিযোগগুলোকে বাদ দিলে বলা চলে নির্বাচনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দুই বছর বাদ দিয়ে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেসময় দেশে যে রাজনৈতিক বৈরিতা–সংঘাত ছিল সেগুলোকে একটা ভাল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৌঁছানোর সংগ্রাম হিসেবেই দেখতে হবে। প্রশ্ন হলো এরকম পরীক্ষিত একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলো কেন? আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামীলীগের মত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস আছে তারা কেন সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে? কেন একটা পরিপূর্ণ পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা নিয়েছে?
এই প্রশ্ন দুটির উত্তর পেতে বাংলাদেশের জানা রাজনৈতিক ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনা খোলামেলা পর্যালোচনা করা জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ যে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া নয় বরং এটা অন্য অনেক ঘটনার উপজাত বা ফলাফল, সে প্রসঙ্গে ডিবিসি নিউজের সাতকাহন নামক টক শোতে (ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯) নাইমুল ইসলাম খান বলেছিলেন, “আমি মনে করি যে আমাদের গনতন্ত্র নিশ্চিতভাবেই একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার মত একটা অবস্থা। … প্রধান দলগুলো নিজেদের পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট থেকে বিষয়গুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিজেদের তৈরি করা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উপস্থাপণ করে। যেমন বিএনপি নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভেঙে পড়াকে সমস্যা হিসেবে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আওয়ামীলীগ এখানে মুক্তিযুদ্ধ/ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে ভুলুন্ঠিত হয় এবং কীভাবে বিরোধী দল এব্যাপারে নিস্পৃহ সেটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করে। আবার বঙ্গবন্ধু বিষয়ে বিরোধীদলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপি- জামায়াতের শ্রদ্ধা, মর্যাদার বিষয়টা অস্পষ্ট। এই বিষয়গুলোতে সবাই মিলে একটা সমাধানের দিকে যেতে যত দেরি করা হবে মূল সমস্যার সমাধানও ততো বিলম্বিত হবে।” অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক সংকটকে সরাসরি দূর করার চেষ্টা না করে (কারণ সেটা কাজ করছে না) এই সংকটের কারণগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে দূর করার চেষ্টা করলে ফলাফল পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের উচিত এভাবে ভাবতে শুরু করা। কেন এমন বলছি সেটা পরের অনুচ্ছেদগুলোতে স্পষ্ট করা যাবে বলে আশা করছি।
বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে যারা হত্যা করেছে, তারাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে আওয়ামীলীগ নামের রাজনৈতিক দলটির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল। হত্যাকারীদের দায়মুক্তি এবং পুরস্কার দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। একারণে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে তার জড়িত থাকা বিষয়ে একটা জোর অনুমান চালু আছে। অনেকেই মনে করেন জিয়া এবং মোশতাক দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনাটি সাজিয়েছিলেন। তাই সামরিক ছত্রছায়ায় জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন তখন থেকেই আওয়ামীলীগ এই দলটির প্রতি বিরূপ ছিল।
আমাদের মনে আছে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামীলীগ বিএনপি পরস্পরের প্রতি সহনশীল হয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ভালভাবে দেশ পরিচালনা করেছে। আওয়ামীলীগও মোটামুটি দায়িত্বশীল বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করেছে। মাগুরা নির্বাচনে কারচুপিকে ইস্যু করে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ’৯৬-র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি সেই দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নতুন নির্বাচনের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। এই অসাংবিধানিক দাবি মানতে বিএনপি বাধ্য ছিল না। কিন্তু তারা বিরোধী জনমতকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিএনপির এই অনুকরণীয় উদারতাই কার্যত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথকে সুগম করেছিল। এর সুফল আমরা ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভোগ করেছি।
বর্তমান সংকটের সূত্রপাত হয় ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে অচল করে রাখে, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিতে হাত দেয়। যেমন জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে। এবং খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করতে শুরু করেন যা আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী সমর্থকদের আবেগকে ভীষণভাবে আহত করে। কারণ বিভিন্ন নথিতে পাওয়া তার চারটি জন্মদিনের কোনটিই ১৫ আগস্ট ছিল না। এই কাজগুলো অনৈতিক হলেও বড় সংঘাত তৈরির কারণ তৈরি করেনি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি হওয়া চমৎকার একটা গণতন্ত্রের আবহ আমূল পাল্টে যায় একটি মাত্র ঘটনায়— ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা।
শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন তার পিতা-মাতা-ভাইদের হত্যাকান্ডের সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন। এরপরও তিনি তারেক-কোকোর বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার সাথে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হবার পর এক সাংবাদিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “নির্বাচনে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণই তাদের বিচার করেছে।” এবং প্রথম দফার শাসনামলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেননি। অনুমান করা যায় যে তিনি অতীত ভুলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মাথায় যখন গ্রেনেড মারা হলো তখন হয়তো তিনি বুঝে ফেলেছেন যে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্রের পথেই আছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বড় রাজনৈতিক নেতাদের ৮০%-৯০%-ই আওয়ামীলীগ বা তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলের সদস্য। গণবাহিনী, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর হাতে আওয়ামীলীগের মোট ২৩ জন সাংসদ খুন হন। ২১ আগস্টের হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা।
কিন্তু মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। এসময়ই সম্ভবত শেখ হাসিনা বুঝে যান যে ডার্টি গেম খেলা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা এমনকি প্রাণে বেঁচে থাকাও তার জন্য কঠিন হবে এবং এমন একটা গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসবে যারা বঙ্গবন্ধু ও তার অনুসারীদের অবদানকে ’১৯৭৫- ’৯৬ সময়ের মত ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ব্যর্থ হবার পর বিএনপিও বুঝে ফেলেছিল সামনের দিনগুলো তাদের জন্য কুসুমাস্তীর্ণ হবার পরিবর্তে কণ্টকময় হয়ে যেতে পারে। সেকারণে তারা যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। ২০০৬ সালে বিএনপি বিচারপতি হাসানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ তারা জানতো আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে তারা ফেঁসে যাবে এবং তারেক জিয়া বড় শাস্তির মুখোমুখি হবেন। গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনায় তারেক জিয়া তার মা-র সাথে আলোচনা করে অগ্রসর হয়েছিলেন কিনা সেটা এই দুইজন ছাড়া অন্য কেউ বলতে পারবে না। যদি ব্যাপারটা সেরকম হয়ে থাকে তাহলে তাদের মনে ভয় থাকাটা স্বাভাবিক। সেকারণেও তারা ক্ষমতার পালা বদল ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠে থাকতে পারেন।
২০০৮-র নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ ধীরে ধীরে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি- জামায়াতকে বেঁধে ফেলতে শুরু করে এবং ২০১৪ ও ’১৮ সালে কৌশল ও শক্তির যুগপৎ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। অতীতে আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে কোন রাজনৈতিক দল পাঁচ বছরের বেশি জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি। এখন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাই বেশি। আওয়ামীলীগের সমর্থক বাদে জনগণের একটা বড় অংশ দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরে পেতে চায়। কিন্তু আওয়ামীলীগ সেটা চায় না। তারা বিএনপিকে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর বা ২১ আগস্টের ঘটনার সাথে জড়িত শক্তির প্রতিনিধি বলে জোরালভাবে বিশ্বাস করে। এরকম একটা শক্তির কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনতে তারা রাজি নয়; রাজি থাকার কথাও নয়। এখানে নীতি- নৈতিকতা, সংবিধান তাদের কাছে মুখ্য নয়। ক্ষমতার লড়াই থেকে সৃষ্ট জনগণের ভোগান্তির দিকে দৃষ্টি দেওয়ার মত অবস্থায় আওয়ামীলীগ নেই। এখন যেটা শুরু হয়েছে সেটা জিরো সাম গেম। একটা বড় সংঘাতের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ বা বিএনপি বিলুপ্ত হয়ে গেলে অথবা মুসলিম লীগের মত নিস্ক্রিয়তার পর্যায়ে পৌঁছালে সমস্যার একটা সাময়িক সমাধান হবে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর বিভিন্নভাবেবিধ্বস্ত আওয়ামীলীগ প্রায় অস্তিত্বহীন নিষ্ক্রিয় দলে পরিণত হয়েছিল। ফলে তার শাসনামলে দেশে কোন সংঘাত হয়নি। এটা ভাল সমাধান ছিল না বলেই এখন আবার সংকট দেখা দিয়েছে।
দেশে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির মতাদর্শের প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত দুটি বিশাল জনগোষ্ঠী আছে এবং তাদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয় এই সত্যটা আমাদের বুঝতে হবে। কোন দল বিলুপ্ত হয়ে গেলে জনগণ একই চেতনা ধারণ করে এরকম আর একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজে নেবে। যেমন মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সেই চেতনার মানুষেরা বিএনপিতে সমবেত হয়েছে। আওয়ামীলীগ বিলুপ্ত হয়ে গেলে তার সমর্থকরা জাতীয় পার্টিতে বা বিএনপি বিরোধী অন্য কোন দলে যোগ দেবে। এই সমীকরণ বুঝতে সহজ হবে এরকম একটা উদাহরণ দেখা যাক। বিএনপি ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। সে নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী আব্দুর রহমান ফকির বগুড়া ৬ আসন থেকে দুই লাখ পঁচিশ হাজার ভোট পেয়ে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯১-র নির্বাচনে আব্দুর রহমান ফকিরের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছিলেন আড়াই লাখ ভোট। তার অর্থ ’৮৬-র নির্বাচনে বিএনপির পুরো ভোটই জামায়াতের বাক্সে গিয়েছিল।
১৯৪৭ বা ১৯৭১-র চেতনার কোন একটি আমাদের দেশ থেকে মুছে যাবে এটা যারা কল্পনা করেন তারা ভুল পথে আছেন। ’৪৭ এখনও একটা জ্বলন্ত চেতনা যা ’৭১-কেও ছাপিয়ে যেতে পারে। যারা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েছেন তারা এই চেতনার ঐতিহাসিক ভিত্তিটা জানেন। বর্তমানে দেশে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী আছে যারা মুখে ’৭১-র কথা বলেন কিন্তু তাদের অন্তরের খুব গভীরে প্রোথিত আছে ’৪৭। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে রাজনৈতিক বিতর্কগুলো দেখলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার ধরণটা বোঝা যায়। যে ভিডিওতে তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধুকে ‘পাক বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন সেটাতে লাইক সাইন দিয়েছে ৩৭ লক্ষ মানুষ, শেয়ার হয়েছিল ৬ লক্ষ। বঙ্গবন্ধুকে ‘পাক বন্ধু’ বললে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রভাবিত কোন মানুষ খুশি হবার কথা নয়। ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে এই মানুষদের প্রত্যেকেই ’৭১ সালে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে সন্তুষ্ট ও গর্বিত বলে দাবি করবে। এই স্ববিরোধিতার কারণ বিশ্লেষণ করলে আমরা প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারবো।
নাইমুল ইসলাম খানের ধারণার পুনরাবৃত্তি করে বলছি, আমাদের রাজনীতি থেকে সংঘাত দূর হতে পারে যদি সাময়িক সমাধানের পথে না গিয়ে বৈরিতা/সংঘাতের মুল উপাদানগুলোকে আমরা নির্মূল করতে পারি। বর্তমান সংকটের সমাধান হবার খুব ক্ষীণ যে একটা সম্ভাবনা আছে সেটা হলো নির্বাচনের সংকট নিয়ে আলোচনা আপাতত স্থগিত রেখে আওয়ামীলীগ-বিএনপির মধ্যে বৈরিতা, অবিশ্বাস ও চেতনাগত পার্থক্য দূর করার চেষ্টা করা। আগেই বলেছি কাজটা কঠিন বা অসম্ভবের কাছাকাছি। কারণ দুই দলের বিশ্বাসের ধরনে পার্থক্য বিস্তর। যেমন বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতার পাঁচ স্থপতির হত্যাকান্ডের নিন্দা না করে বিএনপি এক ধরণের প্যাঁচানো ব্যাখ্যা দেয় যা থেকে বুঝতে অসুবিধা থাকে না যে এই ঘটনায় তারা খুশি। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়, খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে দুই দল পরস্পরের প্রতি অভিযোগ করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের একক নেতৃত্বে ছিল আওয়ামীলীগ। ইতিহাস বিকৃত করে অতিরিক্ত কৃতিত্ব দাবি করার দরকার তাদের নেই। ইতিহাস বিকৃত হলে আওয়ামীলীগেরই ক্ষতি। তারা বরং বিপদে আছে অন্যভাবে; আওয়ামীলীগের কৃতিত্বে অন্যরা অযাচিত ভাগ বসাচ্ছে। যেমন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন…।” কিন্তু বিএনপি তার বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীর আবেগকে পুঁজি করে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে চলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াতের সাথে মাঠে না নামলেও বিভিন্নভাবে এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সম্ভব সবকিছুই করেছে বিএনপি। তারা মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিডিআর হত্যাকান্ড ও শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে অসংখ্য কাল্পনিক অভিযোগের হাটুরে আসর বসিয়ে আওয়ামীলীগকে রীতিমত কোণঠাসা করে ফেলেছে।
বিএনপি যদি এই বিশ্বাস ধরে রাখে যে তাদের জনপ্রিয়তার একটা ভাল উৎস গুজব তাহলে এর চর্চা থেকে বের হয়ে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনতে তারা রাজি থাকবে বলে মনে হয় না। ১৯৭৫ সালের আগে এদেশের এক লক্ষ মানুষের মধ্যে একজনও জিয়াউর রহমানের নাম শুনেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে বিএনপি তাকে স্বাধীনতার দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। বিগত পাঁচ-ছয় বছরে তারা ভয়াবহভাবে বিকৃত একটা ন্যারেটিভের পেছনে সময় দিচ্ছে- “বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে পাকিস্তানে গিয়ে আয়েশে ছিলেন; জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।” এই গল্পের অবাক হবার মত বাজার আছে। তাহলে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের চর্চা করে এই সহজলভ্য সুবিধা থেকে বিএনপি নিজেদের বঞ্চিত করবে কেন! তাহলে কি বাংলাদেশের রাজনীতি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ ছুঁয়ে ফেলেছে? উত্তরটা হয়তো দুঃখজনকভাবে ‘হ্যাঁ’ বাচক। তবে ফেরার পথ খুঁজতে দোষ নাই।
সমাধান চাইলে দুই দলের বৈরিতার প্রধান উপাদানগুলোকে এজেন্ডায় নিয়ে খোলা মনে জাতীয় পর্যায়ে একটা গোলটেবিল বৈঠক/ন্যাশনাল কনভেশন আয়োজন করা যেতে পারে। সেখানে, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ ও সকল প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন। সপ্তাহ বা পক্ষকালব্যাপী (মাসব্যাপীও হতে পারে) আলোচনায় শুধু সেই বিষয়গুলো থাকবে যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। যেমন, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ২১ আগস্টের হত্যাকান্ড, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বাকশাল, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, সামরিক শাসন (’৭৫-’৯০), যুদ্ধাপরাধের বিচার, ২০১৪, ১৮-র নির্বাচন – এসব বিষয়ে দলগুলো তাদের ব্যাখ্যা ও বর্তমান অবস্থান উপস্থাপন করবে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য সবগুলো পক্ষ এই ঘটনাপ্রবাহে তাদের দায় স্বীকার করে ভবিষ্যতে সকল পক্ষের প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার করলে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
যেমন বিএনপি যদি এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতা অভিধা অক্ষুন্ন থাকবে এবং আওয়ামীলীগ যদি প্রতিশ্রুতি দেয় যে তাদের দিক থেকে কখনই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ ভুমিকার কোন অমর্যাদা হবে না তখন যে দলই ক্ষমতায় আসুক প্রতিপক্ষ মর্যাদা হারানোর ভয়ে আর বিপন্ন বোধ করবে না। ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক প্রতিনিধিরা তাদের অনৈতিক দলীয় আনুগত্য ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধে তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করবেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অপারগতার দায় মেনে নেবেন। এরপর সমঝোতার একটা সুপারিশ তৈরি করবেন বিশেষজ্ঞরা — যা মানা সকল পক্ষের জন্য ঐচ্ছিক হবে। তবে আশা করতে দোষ নেই যে দীর্ঘ আলোচনা থেকে তৈরি করা এই সুপারিশগুলো সব পক্ষই কমবেশি মেনে নেবে। এরকম একটা কনভেশন আয়োজনের জন্য কয়েকজন জাতীয় ব্যক্তিত্বকে প্রাথমিক উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগটা ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. আকবর আলী খান বা তাদের মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আসতে পারে। তবে এ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেই।
সমঝোতা যদি যৌক্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে বিএনপিকে আওয়ামীলীগের চেয়ে অনেক বেশি ছাড় দিতে হবে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সম্প্রতি আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পিতা’ ধরণের অস্পষ্ট কিছু একটা দাবি করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা দেখলে বোঝা যায় বিএনপির সমর্থকদের একটা বড় অংশ এসব বিশ্বাসও করতে পছন্দ করে। এরকম চলতে থাকলে একটা বিভ্রান্ত ইতিহাস স্থায়ী রূপ পেয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। মুক্তিযোদ্ধারা এই স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ করেছে। দল গঠনের সময় বিএনপির হাতেও সুযোগ ছিল জয় বাংলা স্লোগানটিকে গ্রহণ করার — যা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে জাতীয় সংহতির প্রতীক ছিল। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এর প্রতিষ্ঠাতাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা আওয়ামীলীগকে স্লোগানটির একক দাবিদার হতে দিচ্ছেন কেন! বিএনপি যদি ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে ৭১-র প্রবাসী সরকারের পাঁচ নেতার ছবি তাদের অফিসে টানিয়ে দেয় তাহলে আওয়ামীলীগ তো তাতে বাধা দিতে পারবে না! এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যাবে এবং এ বিষয়ে বৈরিতারও অবসান হবে।
আওয়ামীলীগকেও সমঝোতার স্বার্থে অনেক বড় ছাড়ই দিতে হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করলেও বিএনপি তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে রায়টা মেনে নেয়নি কারণ তাতে তাদের রাজনৈতিক শক্তি অর্ধেকে নেমে আসবে। তারেক জিয়ার সাথে বিএনপির অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। আওয়ামীলীগ যদি তার দন্ড মওকুফের মত উদারতা দেখাতে পারে তাহলে দুই দলের বৈরিতা সহমর্মিতায় রুপান্তরিত হবার সম্ভাবনা আছে। খালেদা জিয়া তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে তার অনমনীয় দৃঢ়তা আমাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা উচিত। যে অপরাধে তিনি সাজা ভোগ করছেন সেরকম অপরাধ আমলে নিলে দেশের এক লাখ মানুষকে একই সাজা দেওয়া যাবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তার বিরুদ্ধেও হয়তো এরকম অভিযোগ আনা যাবে। এরকম পদে থাকা একজন মানুষকে কয়েক লাখ নথিতে স্বাক্ষর করতে হয়। সেখানে স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় বা ভুলক্রমে কিছু ব্যত্যয় ঘটে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা পাবার উদ্দেশ্য থেকে। অন্য অনেকের বিরুদ্ধে সেটা করা হয়নি।
বৃহত্তর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়ার দন্ড মওকুফ করা হলে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। বিষয়টা যত সহজে বলা গেল, এর বাস্তবায়ন হয়তো ততটা সহজ হবে না। পরিকল্পনা করে কেউ আমাকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল এটা জানার পর তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া আমার পক্ষে যেমন কঠিন অন্যের পক্ষেও তা-ই। ১৯৭০ এ ঢাকার এক জনসভায় ভুট্টো উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “শুয়োর কা বাচ্চা, জাহান্নাম মে যাও…।” মূলত ভূট্টোর খমতালিপ্সার কারণে বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর বাধাগ্রস্থ হয় এবং পরবর্তীতে ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। যুদ্ধে পরাজিত হবার পর সেই ভূট্টোই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু তার ডাকে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ওআইসি সন্মেলনে যোগ দিলেন। ফলাফল হলো, ’৭৪ এ ঢাকা এসে ভূট্টো “তওবা … তওবা” বললেন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন (যেক্ষেত্রে সৌদি আরব এবং চীন স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭৫ এ)। বঙ্গবন্ধুর এই আকাশচুম্বী উদারতার উদাহরণ যদি শেখ হাসিনা গ্রহণ করেন তাহলে চমৎকার একটা জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে যেতে পারে এবং জাতির জন্য তা বড় মঙ্গল বয়ে আনতে পারে।
জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আপিল শুনানিতে সুখরঞ্জন বালী যাতে সাক্ষ্য দিতে না পারেন সেজন্য সরকারের কোন এজেন্সিই তাকে অপহরণ করে ভারতে রেখে এসেছিল বলে ভাল কিছু সূত্র থেকে জানা যায়। ভাল অবস্থানে থাকা সাংবাদিকরাও অফ দ্য রেকর্ড সেটা জানেন। তিনি সাক্ষী দিলে সাঈদীর ফাঁসির রায় বহাল রাখা ছাড়া আদালতের সামনে কোন পথ খোলা থাকত না। ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার আর সাধারণ আদালতে ফৌজদারি আইনে বিচার এক জিনিস নয়। যুদ্ধাপরাধ আইনে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির জন্য সরাসরি মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সাঈদীকে ফাঁসি দিলে যে জনরোষ তৈরি হবে সেটা সামাল দেওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে এই চিন্তা থেকে সুখরঞ্জন বালীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই বিপুল জনপ্রিয় ইসলামী বক্তার দন্ড মওকুফ করে দিলে সেটা হয়তো ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে। তবে সেটা দেশে রাজনৈতিক সংঘাত কমাতে খুবই সহায়ক হবে। জনঅসন্তোষ নিবারণ করা কখনও কখনও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ’৭১-র ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামী কখনও দুঃখ প্রকাশ করেনি। কিন্তু এখন তো তারা অন্তত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পক্ষে। এটাকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত।
জিয়াউর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৭ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন। তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন (তার আগে এরকম ঘোষণা অন্য দুজনও দিয়েছেন; সেটা অন্য প্রসঙ্গ), কামালপুরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সিলেট দখল করার সময় জেনারেল কে ভি কৃষ্ণ রাওয়ের বাহিনীর পাশাপাশি তার বাহিনী বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছে এবং সর্বোপরি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। তিনি শাসক হিসেবে অবৈধ ছিলেন, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক যা এদেশে খুবই জনপ্রিয় একটা রাজনৈতিক দর্শনের ধারা। জিয়া বা তার মত বীর যোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলুষিত হবে। বিস্তর সুযোগ থাকা সত্বেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেননি। তার নির্দেশে হাসান হাফিজুর রহমান ১৫ খন্ডে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র সংকলন করেছেন সেটা ছিল বিস্ময়কররকম পক্ষপাতহীন। পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে পাকিস্তানের চর বলে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছেন, তাকে ‘মেজর রিট্রিট’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এমনকি সংসদেও তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি তার খেতাব প্রত্যাহারেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামীলীগকে এধরণের অর্বাচীনতা থেকে বের হতে হবে। ’৭৫ এবং এর পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সকল অসাংবিধানিক কাজের (ক্ষমতা দখল, ইনডেমনিটি পাশ, দালাল আইন বাতিল…) সমালোচনা হতে পারে; এমনকি স্বাধীনতার পাঁচ স্থপতির হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার খেতাব প্রত্যাহারের যৌক্তিকতাও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় কাজটি অনুচিত হবে। এভাবে এগোতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ওসমানীসহ আরও অনেকের ভূমিকা নিয়ে কমবেশি প্রশ্ন উঠবে। মোশতাক সরকারের সামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব অনেকটা নিজ গরজে গ্রহণ করেছিলেন ওসমানী। বিতর্ক থেকে বাঁচতে আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীরদের কেউ যদি পরবর্তীতে কোন অপরাধ করে থাকেন তাহলে সেগুলো যতটা সম্ভব উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে সবকিছুর উর্ধে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে রাখা।
সংসদ ভবন চত্ত্বরে জিয়াউর রহমানের মাজার (এবং অন্য আরও কয়েকজন নেতার কবর) তৈরি করা একটা বেআইনি এবং অনৈতিক কাজ হয়েছে। এটাকে সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রেও আওয়ামীলীগ-বিএনপির সমঝোতা দরকার। সমঝোতা না হলে এবং আওয়ামীলীগ আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে তারা এককভাবেই এটা সরিয়ে ফেলবে। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটা পুনস্থাপন করবে। চার হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি যার অবিসংবাদিত, অতিমানবীয় নেতৃত্বে একটা রাষ্ট্রের মালিক হয়েছে, শেখ হাসিনা তার আত্মজা। তার নেতৃত্বে আমরা বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়ে চলেছি। পাল শাসনের পর ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত আমরা একটা আত্মনির্ভরশীল সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বেই। তিনি খোলা মনে আমাদের জাতীয় জীবনে বিভ্রান্তি, বৈরিতা, বিতর্ক অবসানের আহ্বান জানাতে পারেন, উপরের প্রস্তাবনা অনুযায়ী উদ্যোগ নিতে পারেন। প্রতিপক্ষ তার আহ্বানে সাড়া দেবে বলে আশা করা যায়। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি গণমানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত শ্রদ্ধা আছে। সুপ্ত এই ভাল গুণটিকে যিনি যত বেশি উদ্দীপ্ত করতে পারেন তিনি তত বেশি মহান নেতা।
মার্চ ১৬, ২০২১, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা