মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং দেশের সকল কওমি মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে সমাজ থেকে কূপমণ্ডূকতা দূর হবে না। আর এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দেশের উন্নয়নকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করতে থাকবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক, একজন ইসলামী পণ্ডিত, একজন তুখোড় ইসলামী বক্তাও বটে, যার ডাকে মুহূর্তের মধ্যে তাঁর হাজার হাজার অনুসারী ইসলাম রক্ষার নামে রাস্তায় নেমে আসে, সরকারি-বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস করে, এমনকি মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়। যার ইসলামী ওয়াজ শুনে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালনে অনুপ্রাণিত হয়, তাঁর কাছ থেকেই তাঁর বক্তব্যের এবং আদর্শের বিপরীতধর্মী কার্যকলাপ কি সমাজের মানুষ মেনে নিতে পারে?
একদিকে এই লোকগুলো মানুষকে ধর্মীয় উন্মাদ বানাচ্ছে অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনে নিজেদের খায়েশ এবং স্বার্থ চরিতার্থে ব্যাপৃত রয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁরা ফতোয়া উল্টিয়ে দিতে পারেন। তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম অনুযায়ী স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে বা খুশি করার জন্য প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে কোনো সত্য গোপন করারও অবকাশ রয়েছে।’
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এই সমস্ত কূপমণ্ডূককে প্রশ্রয় দিচ্ছি? এর মূলে রয়েছে ধর্মীয় গুরু ও পণ্ডিতদের প্রতি বিবেচনাহীন অতিরিক্ত এবং অন্ধ আনুগত্য। আর এই অবস্থা সৃষ্টির পিছনে রয়েছে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, অশিক্ষা এবং দরিদ্রতা। এই অবস্থা থেকে দেশ, জাতি ও সমাজের উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদেরকে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু প্রস্তাবনা রাখা যেতে পারে সরকার, শিক্ষাবিদ ও বিদগ্ধজনের বিবেচনার জন্য।
প্রথমত, দুই ধরণের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় এবং সম্পদের অপচয়। আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলাম সম্পূর্ণরূপে স্কুল কলেজের কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করাটাই হবে দেশ ও জাতির জন্য উপকারী। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছেলেমেয়েরা বেকার হয়ে পড়ে, ধর্মীয় জ্ঞানের দিকেও তাদের ঘাটতি লক্ষণীয়। অনেক আলিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য অথচ সরকার সেখানে শিক্ষক ও কর্মচারীদেরকে ১০০ ভাগ বেতন দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি সরকারের দায়িত্ব যে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে, সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে তা অনুমোদন দেয়া এবং তদারকি করা। বর্তমান মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে কওমি মাদ্রাসাগুলো তাদের কার্যক্রম চালনা করতে পারে। আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলাম স্কুল-কলেজের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলে যেতে পারে।
এখানে আর একটি প্রস্তাবনা হচ্ছে, দেশে কতগুলো এবং কী পরিধির মাদ্রাসা থাকবে তার একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা দেশের মাদ্রাসাগুলো এবং মসজিদের জন্য আমাদের কি পরিমাণ আলেম, ওলামা, হাফেজ প্রয়োজন তার সাপেক্ষে। মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে ভোকেশনাল ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করা দরকার যাতে ছাত্রছাত্রীরা পাশ করে বের হওয়ার পর বেকার না থাকে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে প্রতি ৩ জন শিক্ষার্থীর ১ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। এই বিপুল জনগোষ্ঠী দেশ ও সমাজের জন্য কতটুকু কী অবদান রাখতে পারছে তা আমাদের ভাবতে হবে। এত বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষ দেশের জন্য প্রয়োজন আছে কিনা তা বিবেচনা করে সরকারের নীতি নির্ধারণ বা পরিবর্তন করতে হবে।
সর্বোপরি, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং দেশের সকল কওমি মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে সমাজ থেকে কূপমণ্ডূকতা দূর হবে না। আর এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দেশের উন্নয়নকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করতে থাকবে। তাতে আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল অর্জনে দেশ ব্যর্থ হবে। সরকারের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের পরকল্পনা অর্জনও পিছিয়ে যাবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
আশা করব, সরকার বর্তমান সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ গঠনে মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কারে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নেবেন দেশের শিক্ষাবিদ, নাগরিক সম্প্রদায় ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে।