নরবলি কী?
বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় যেসব বিষয় মনুষ্যত্বকে কলঙ্কিত করেছে, ‘নরবলি’ সেগুলোর মাঝে নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয়। সেই খ্রিস্টপূর্ব সময়কাল থেকে শুরু করে এই একবিংশ শতকেও পাওয়া গেছে নরবলির বিভিন্ন নমুনা। তেমনই কিছু ইতিহাস নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এ লেখাটি।
১. কার্থেজ
প্রাচীন বিশ্বে অন্যতম সমৃদ্ধিশালী এবং একইসাথে ক্ষমতার অধিকারী ছিলো কার্থেজের অধিবাসীরা। কিন্তু এরপরও তাদের মাঝে এমন কিছু অদ্ভুত রীতিনীতি প্রচলিত ছিলো যা তৎকালীন অনেকের কাছেই বেশ বর্বর হিসেবে ঠেকতো। এর মাঝে অন্যতম ছিলো শিশুবলি দেয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তেই তারা সেসব করতো। আরেকদিক দিয়ে ঘৃণ্য এ কাজটি তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। কার্থেজের ধনী লোকেরা তাদের সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য নিজেদের সন্তানদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতো।
Source: Dennis Jarvis/Flickr
অনেকেই অনুমান করে থাকেন ৮০০ থেকে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত (এ সময় রোমানরা কার্থেজ দখল করে নেয়) কার্থেজের আনুমানিক ২০,০০০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছিলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলি দিতে গিয়ে। তবে এ মতের বিরোধীতাও করে থাকেন অনেক ঐতিহাসিক। তাদের মতে সেই শিশুদের অনেকে প্রাকৃতিক কারণেই মারা গিয়েছিলো।
২. ইসরায়েল
বিশেষজ্ঞদের মতে, নরবলি প্রচলিত ছিলো প্রাচীন ইসরায়েলেও। সেখানকার অধিবাসীরা তাদের শিশুদেরকে পুড়িয়ে এ বলিদানের কাজটি সারতো। আর যে দেবতার উদ্দেশ্যে এমনটি করা হতো, তার নাম ছিলো মলোখ। তবে তাদের সবাই যে এমনটা করতো সেটা না। এক গুপ্ত সংঘের সদস্য, যারা মলোখকে তাদের দেবতা হিসেবে মানতো, তারাই এমনটা করে থাকতো।
Source: TopTenz
তবে এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন অনেক ইতিহাসবিদই। তাই আজও এর সত্যতা রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
৩. এট্রুস্কান সভ্যতা
প্রাচীন ইতালির বেশ সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান এক সভ্যতার নাম এট্রুস্কান। টুস্কানি, পশ্চিম আম্ব্রিয়া ও উত্তর লাজিওতে ছিলো তাদের বসবাস। মূলত কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই জীবিকা উপার্জন করতো তারা। কার্থেজ ও গ্রীসের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। পাশাপাশি বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যও তাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতো।
Source: TopTenz
এমন একটি সভ্যতার মাঝেও যে নরবলির মতো বিষয়টি প্রচলিত থাকবে, তা অনেক ইতিহাসবিদই মানতে চান নি। তবে ইউনিভার্সিটি অফ মিলানের একদল প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণায় সেটারও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো। টার্কুইনিয়াতে তারা এমন কিছু বলি দেয়া মানুষের কবরের সন্ধান পেয়েছিলেন। এদের মাঝে ছিলো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা যারা অসুস্থ, নিম্ন সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন কিংবা ভিনদেশী ছিলো।
৪. চীন
নরবলির বিষয়টি প্রাচীন চীনে বেশ সাধারণ একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এর সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটেছিলো শ্যাং রাজবংশের শাসনামলে। তখন অবশ্য এত বৃহৎ পরিসরে সংঘটিত নরবলির দুটো উদ্দেশ্য ছিলো- রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খতম করা এবং স্রষ্টার মনোরঞ্জন করা।
Source: Chinese Cultural Relics
চীনের সেই নরবলিগুলো হতো তিন রকমের। মাটিতে গর্ত করে উৎসর্গ করা হতো যুবকদের। তাদের সবারই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা থাকতো, সাথে থাকতো না নিজেদের ব্যবহার্য কোনো জিনিসও। বিভিন্ন স্থাপনায় বলি দেয়া হতো শিশুদের। তাদের মৃত্যুটা কার্যকর করা হতো বেশ মর্মান্তিক উপায়ে। কিছুটা আলাদা জায়গায় বলি দেয়া হতো কিশোরী ও তরুণীদের। অবশ্য প্রথম দু’শ্রেণীর মতো তাদের মৃতদেহের করুণ অবস্থা হতো না। দুর্ভাগা সেই কিশোরী ও তরুণীদের মৃতদেহের সৎকার ঠিকমতোই করা হতো।
৫. হাওয়াই
এককালে হাওয়াইয়ের অধিবাসীরা মনে করতো নরবলি দেয়ার মাধ্যমে তারা যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার দেবতা ‘কু’-এর আশীর্বাদ লাভ করতে পারবে, প্রতিপক্ষকে হারাতে পারবে নানা যুদ্ধে। এ আশায় তাদের মন্দিরগুলোতে চলতো নরবলি, যেটিকে তারা বলতো ‘হেইয়াউ’। সাধারণত বিভিন্ন প্রতিপক্ষ গোত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, যারা যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলেন, তাদেরকেই বলি দেয়ার জন্য বেছে নেয়া হতো।
Sourcce: TopTenz
এজন্য সেই দুর্ভাগাকে কোনো কাঠের ফ্রেমে প্রথমে উল্টো করে ঝোলানো হতো। তারপর তাকে এমনভাবে পেটানো হতো যে তাতেই বেচারার প্রাণপাখি উড়াল দিতো। অতঃপর লোকটির নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা হতো। বলি কিন্তু ততক্ষণে মাত্র অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। এবার সেই মৃতদেহ হয় রান্না করা হতো কিংবা কাঁচা খাওয়া হতো। খাদকদের মাঝে থাকতেন পুরোহিত ও গোত্রপতিরা।
৬. মেসোপটেমিয়া
বর্তমান ইরাকের অধিকাংশ, কুয়েত, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তুর্কি-সিরীয় ও ইরান-ইরাক সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো এককালে মেসোপটেমিয়ার অংশ ছিলো। এখানকার অধিবাসীদের মাঝেও নরবলির প্রথা প্রচলিত ছিলো। রাজসভার সভাসদবর্গ, যোদ্ধা ও চাকরদেরকে তাদের মালিকের সাথে কবর দেয়া হতো যেন পরকালেও তারা তাদের মালিকের সেবা-যত্ন করতে পারে। যোদ্ধাদের সাথে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেয়া হতো, অপরদিকে চাকরদের মাথায় শোভা পেতো পাগড়ি।
অনেকদিন ধরেই ঐতিহাসিকেরা মনে করতেন এই লোকগুলোকে মারতে বিষ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এ ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দুর্ভাগা সেই মানুষগুলোকে মারতে তাদের মাথায় বর্শা ঢুকিয়ে দেয়া হতো!
৭. অ্যাজটেক
নরবলির পেছনে অ্যাজটেকদের দর্শন ছিলো বেশ অদ্ভুত। তারা মনে করতো তাদের দেয়া এই নরবলিই সূর্যকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে! বলির শিকার হওয়া মানুষের রক্তকে তারা বেশ পবিত্র মনে করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো এই রক্ত তাদের সৌরদেবতা হুইতজিলোপোখ্তলির রাগ প্রশমন ও পুষ্টির জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।
Source: More Than অ Magazine | Sia Magazin
অ্যাজটেকদের নরবলি দেয়ার প্রথাটা ছিলো বেশ ভয়াবহ। এতে স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি যুদ্ধবন্দীদেরও ব্যবহার করা হতো। কখনো কখনো বলি দিতে চাওয়া মানুষটিকে প্রথমে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো মন্দিরে। সেখানে অবস্থানরত পুরোহিত লোকটির গলা থেকে শুরু করে একেবারে পেট পর্যন্ত চিরে ফেলতেন! এরপর লোকটির হৃদপিণ্ড উৎসর্গ করা হতো দেবতার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হতো।
৮. মিশর
Source: The অncient Egypt Site
এককালে প্রাচীন মিশরেও প্রচলিত ছিলো নরবলির এ প্রথা। সেখানে একজন দাস বা ফারাওয়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীকে তার সাথে কবর দেয়া হতো যেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও তিনি তার মনিবের সেবা করে যেতে পারেন। ইজিপ্টোলজিস্ট জর্জ রেইজনার জানিয়েছেন, রাজা জার ও আহার কবরগুলো তাদের ভৃত্যদের দিয়ে পরিপূর্ণ ছিলো। সেই ভৃত্যদের সাথে দেয়া হয়েছিলো বিভিন্ন দরকারি জিনিসপত্র যাতে পরকালে মনিবের সেবা করতে কোনোরুপ অসুবিধা না হয়!
৯. ইনকা
ইনকা সভ্যতার লোকেরা স্রষ্টার সন্তুষ্টির নিমিত্তে নরবলি দিতো। এজন্য তারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো শিশুদের। প্রায়ই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতো ইনকা সাম্রাজ্য। তারা মনে করতো কেবলমাত্র নরবলির মাধ্যমেই এসব দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে প্রাণ হারাতে হতো ইনকা শিশুদের।
ইনকা শিশুদের মমি; Source: Scientific Reports Gómez Carballa et al
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তাদের সমাজে এমন অনেক শিশুও ছিলো যাদের বড় করার উদ্দেশ্যই ছিলো কেবল বলি দেয়া! এসব শিশুদের বলির ব্যাপারকে ইনকারা ‘সবচেয়ে পবিত্র বলি’ হিসেবে মনে করতো। তারা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর এ শিশুরা অনেক সুন্দর এক জীবনের অধিকারী হবে। অবশ্য মৃত্যুর আগে তাদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করা হতো। তাদেরকে দেয়া হতো পছন্দসই খাবার, এমনকি মিলতো সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্যও।
১০. ফিজি
যদিও আজকের লেখায় উল্লেখ করা প্রতিটি বর্ণনাই বেশ কষ্টদায়ক, তবে ফিজির ঘটনাটি আরো বেশিই কষ্টদায়ক। সেখানে এককালে নিয়ম ছিলো স্বামী মারা গেলে তার স্ত্রীকেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে হবে। সেখানকার নানা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বেশ গুরুত্বের সাথেই এ নিয়মটি অনুসরণ করতো। তারা বিশ্বাস করতো স্ত্রীর কর্তব্য হলো ইহকালের পাশাপাশি পরকালেও স্বামীকে সঙ্গ দেয়া। এজন্য স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার সকল স্ত্রীকেই বলির শিকার হতে হতো।
বিধবা এ সকল নারীকে বলা হতো ‘থোথো’, যার অর্থ ‘স্বামীর কবরের গালিচা’! আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো নারীদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করার দায়িত্বটি পালন করতো তাদের আপন ভাইয়েরা। সেটা না করতে পারলে অন্তত নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী তাকে অবশ্যই হওয়া লাগতো।
১১. ডাহোমে
Source: Wikimedia Commons
পশ্চিম আফ্রিকার পুরনো এক রাজ্যের নাম ছিলো ডাহোমে। সেখানে বার্ষিক এক উৎসবের নাম ছিলো জোয়েতানু। জোয়েতানুতে নানা ধরনের আয়োজনের পাশাপাশি অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিলো নরবলি। এজন্য বেছে নেয়া হতো দাস-দাসী ও বিভিন্ন যুদ্ধবন্দীদের। জীবিত ও মৃত রাজাদের সম্মানার্থে সংঘটিত এ নরবলি কার্যকর করা হতো মূলত শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। এটা এতই বহুল প্রচলিত এক চর্চা ছিলো যে, শুধুমাত্র এক রাজার শাসনামলেই আনুমানিক ৭,০০০ লোক এ জোয়েতানুর নরবলিতে মারা যায় বলে জানা গেছে।
১২. মায়া
Source: More Than অ Magazine | Sia Magazin
প্রাচীনকালে মায়া সভ্যতার লোকেরাও এ প্রথা অনুসরণকারীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিলো। বিশেষ কোনো উপলক্ষে তারা এমনটা করতো। নরবলিগুলো মাঝে মাঝে দেয়া হতো মন্দিরে। দুর্ভাগারা অধিকাংশ থাকতো বিভিন্ন যুদ্ধবন্দী। চিচেন ইৎজাতে নরবলি দেয়ার সময় বৃষ্টির দেবতা চাকের সম্মানার্থে বন্দীদের গায়ে নীল রঙ মাখা হতো। এরপর তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হতো কোনো কুয়ায়।
১৩. সতীদাহ
সতীদাহ প্রথার অস্তিত্ব ছিলো আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই। এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী বিধবা হবার পর স্বামীর সাথে সহমরণে চিতায় যাবার বিষয়টিকেই বলা হয় সতীদাহ। নারী কখনো যেতেন স্বেচ্ছায়, কখনো বা জোরপূর্বক তাকে পাঠানো হতো। বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে অমানবিক এ প্রথার অবসান ঘটে।
Source: Hindu Human Rights Worldwide
তবে এখনো এর অস্তিত্ব একেবারে মিলিয়ে যায় নি। ২০০৬ সালে বিবিসির এক খবরে জানা যায়, ভারতের মধ্যপ্রদেশের তুসলিপার গ্রামের চল্লিশ বছর বয়স্কা এক নারী স্বামীর মৃত্যুর পর সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তবে কেউ তাকে বাধ্য করে নি। তিনি নিজেই সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলে পুলিশ জানায়।