মুখোশের অন্তরালে
শফিক হাসান
লকডাউনের নামে যখন কালো পর্দা নেমে এলো দেশে- মোকাব্বির আলম খুশিই হলেন। ব্লকের উপকারিতা উপলব্ধি করে প্রফুল্ল বোধ করতে থাকলেন ক্রমান্বয়ে।
বাসা ভাড়া বাকি পড়েছিলো বলে বাড়িওয়ালা কত কথাই না শুনিয়েছে; লক তার মুখে তালা মেরে দিয়েছে। এক্কেবারে চাইনিজ তালা! নিখিল বঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদ থেকে দুই মাসের বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার আহ্বান জানানোর পরদিন মোকাব্বির কল করলেন বাড়িওয়ালাকে। হার্টের কী অবস্থা জানা দরকার। মাখন মেশানো মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার শরীর-মন সব ভালো তো? গত মাসে ভুতুড়ে বিল এসেছিলো, এ মাসেও কি বিদ্যুৎ বিলের একই দশা হবে!’
খেঁকিয়ে উঠলো বাড়িওয়ালা- ‘আমার শরীর-স্বাস্থ্য যেমনই থাকুক তাতে আপনার কী! মজা লন, মিয়া?’
নিজের দুই গালে মৃদু থাবড়া দিয়ে মোকাব্বির বলেন, ‘এসব কী বলেন? কবি বলেছেন- প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। সে কথা মনে রেখেই কল দিলাম। একদিকে করোনার আতঙ্ক, অন্যদিকে গ্রীষ্মের গরম। আম-কাঁঠালও এবার সময়মতো পাকছে না। রংমাখানো লিচু এসেছে যদিও…।’
দাঁত কিড়মিড় করার শব্দ পেলেন মোকাব্বির। এর পরই বাড়িওয়ালা কল কেটে দিলো। সরকার কর্তৃক সাধারণ ছুটি ঘোষণার দ্বিতীয় দিনেই কিনে আনলেন রংবেরংয়ের কয়েকটি মাস্ক। আগে যে সব পথে চলাচল করতেন না, মুখোশ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে সেদিকে যাতায়াত বাড়িয়ে দিলেন। অন্য অনেকের মতো হুজুগে মেতে তিনিও মাথা ন্যাড়া করে ফেললেন। চুলের ভেতরে আয়েস করে করোনা ভাইরাস সপরিবারে বাসা বাঁধবে, তেমন আশঙ্কা রইলো না আর। সাবান আছে পর্যাপ্ত, বাইরে যাওয়ার আগে একবার, ফিরে আবার ঘষে নেন। বিশ সেকেন্ড যে বিশাল সময় তাও উপলব্ধি করতে সমর্থ হলেন। সময় যেন কাটে না…। ন্যাড়া মাথার সাথে বিস্তৃত মুখোশ ভালোই সুবিধা দিচ্ছে। এই তো সেদিন গলির মোড়ে কুতকুতি জেনারেল স্টোর থেকে সিগারেট কিনে এনেছেন। কুতকুতির বাপ চিনতে পারেনি। পারলে ঠিকই বাকি টাকা চেয়ে প্যানপ্যানানি শুরু করতো।
গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ, লোকজনের এদিক-ওদিক যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সবাই মহল্লার চায়ের দোকানে আড্ডায় মাতে। সহজেই জমে ওঠে টক শো, ঝাল শো ও বিতর্কের ক্লাস। সরকারের দোষাবলি, ত্র“টি-বিচ্যুতি, স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা, ব্রিফিংয়ের খুঁত, শাড়ি ও ফ্যাশন বৃত্তান্ত, চীন-আমেরিকার কূটনৈতিক ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণে সরব অনেকেই। কচকচানির উত্তেজনায় তারা মুখ থেকে মাস্ক খুলে রাখে পাশের বেঞ্চে। কথা বলার সময় মুখ থেকে থুতু ছিটায়। এমনই এক তুমুল আলোচনার সন্ধিক্ষণে মনানন্দে বাজারে যাচ্ছিলেন মোকাব্বির। হাঁটার ছন্দে ছেদ ফেলে ডাক পড়ে- ‘ও মোকা ভাই, চা খাইয়া যান।’
চায়ের অর্ডার পড়ার আগেই ঢোক গেলেন মোকাব্বির। কতদিন ভেবেছেন, এই লোকের মুখের ওপর বলে বসবেন মোকা সম্বোধনে তার নামের অপমান হয়। শেষপর্যন্ত সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। রাগটা পুষে রাখলেন ভেতরে। প্রমাদ গুনলেন মোকাব্বির। আমন্ত্রণদাতা যে হাসমত উল্লাহ হাশেম। তার দীর্ঘদিনের পাওনাদার। এমন নিখুঁত ছদ্মবেশের পরেও চিনলেন কেমনে! মুখোশটা খুলে হাতে নিয়ে হাসার চেষ্টা করেন মোকাব্বির- ‘আজ আমিই আপনাকে চা খাওয়াবো। অনেক দিন তো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। করোনা বাড়িয়ে দিয়েছে দূরত্ব।’
এ কথা সে কথা কত কথা। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায়ও নেই। বিদায়ের আগে চায়ের বিল পরিশোধ করতে হয় ২৬২ টাকা। সকাল থেকে জমতে জমতে এই অঙ্কে এসে পৌঁছেছে। নিমমুখে সব পরিশোধ করে বাজারের পথ ধরেন। মুখোশটা পরার আগে টেনেটুনে লম্বা করে নেন। যাতে বেশি করে মুখটা ঢাকা পড়ে। সামনে অনেকটা পথ। বলা যায় না, কে কখন কোন পাশ থেকে ডেকে বসে!
ফিরতি পথেও হাসমত উল্লাহ হাশেমের কণ্ঠস্বর তাকে আহ্বান করে। এড়ানোর সুযোগ নেই, আবার সায় দিলেও মুশকিল। অনেকটা বাধ্য হয়ে সামনে এসে দাঁড়ান। চতুর হাসমত এবার কণ্ঠস্বরে প্রভূত পরিবর্তন আনেন- ‘লোকজনকে তো এখন অকাতরে চা খাওয়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছেন। এবার আমার পাওনা টাকাটা যদি ফেরত দেন। অনেক দিন তো হলো!’
নিজের অবিবেচনাপ্রসূত কাজে ফাঁদে পড়া মোকাব্বির আঁতকে ওঠেন এমন না-হক আবদারে! বলেন, ‘আরে না, তেমন কিছু না। চা তো খাওয়ালাম শুধু আপনাকে।’
‘সব চা কি আমি একা সাবাড় করেছি! অন্তত বিশজনের অংশগ্রহণ ছিলো ওই বিলে। এবার বুঝুন, আপনার সক্ষমতা কত বেড়েছে। এবার নেকনজরটা এদিকেও দিন!’
চুপ হয়ে যাওয়ার আগেই মোকাব্বির মূক হয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ পর অনেক কসরত করে কাঁচা তিতা করলা চিবানোর স্বাদ মুখে নিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, দেখি। দেনা পরিশোধ করতে পারা মহৎ কাজ।’
‘দেখি বললে হবে না। দেখিয়ে দিতে হবে। আপনিও পারেন!’
এরপর ক’দিন বিকল্প পথে যাতায়াত করলেন। কী আশ্চর্য, সেদিকেও দাঁড়িয়ে গেলো আরেকজন প্রাচীন পাওনাদার। তিনি বুঝলেন, এসব হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কুফল। কালোবাজারি, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি-চামারি সবই লকডাউনের চিপায় পড়েছে। শেষে বুদ্ধি করে মোকাব্বির স্ত্রীর পুরোনো একটা সালোয়ার বের করলেন। সেলাই করে নিলেন নিজের মাপমতো। ফতুয়া টাইপ পরিত্যক্ত কাপড়গুলো বের করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করলেন। ছেঁচড়া পাওনাদারের চোখ থেকে বাঁচার জন্য এমন ছদ্মবেশ কাজে দেবে। কিন্তু তাতেও বুঝি শেষ রক্ষা হলো না। প্রথম হুঁইসেলটা এলো কুতকুতি জেনারেল স্টোর থেকেÑ ‘আপা, শুনে যান!’
আপা মানে! এ কেমনতর সম্বোধন? তিনি শোনেননি ভান করে পা চালালেন। এবার গলা চড়লো কুতকুতির বাপেরÑ ‘ভাবি, আপনাকে ডেকেছি কিন্তু!’
এ কী অসভ্যতা- আপা থেকে ভাবি! সেখান থেকে খালাম্মায় যাবে না তো আবার! তড়িঘড়ি করে তিনি দোকানের ভেতরে আসেন। মিজান মন্ডল লম্বা সালাম দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন মোকাব্বির ভাই? ঘনঘন দেখছি আজকাল। দিনকাল বোধহয় ভালোই যাচ্ছে!’
নিজের চমকানো-টা গিলে ফেলতে হলো। এ ব্যাটা দোকানদার জাদুকর নাকি? এত খোঁজ রাখে! আপা-ভাবির দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভাই সম্বোধনে স্থিত হলো! কুশলাদি বিনিময় করলেন তিনিÑ ‘কুতকুতি কেমন আছে? নিয়মিত সাবান ব্যবহার করাচ্ছেন তো? অবশ্য আপনারা তো কোম্পানির কাছ থেকে শ্যাম্পুর মিনি প্যাকও ফ্রি পান!’
সহানুভূতির বাক্যটাই লুফে নিলেন চতুর ব্যবসায়ী- ‘সাবান কিনতে তো পাত্তি লাগে। এই দিকে ব্যবসায় লালবাত্তি। আর আপনার দেখছি রমরমা অবস্থা- প্রতিদিনই নতুন কাপড়। ফ্যাশনেরও শেষ নেই। সত্যিই আপনি করোনার সুফলভোগী মানুষ। আপনার কাছে ফ্রি শ্যাম্পু বা সোডার চালান কিছুই না!’
‘ঠিক বলেছেন। আসলেই কোথাও আলো নেই। বিশ্ব ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। বিশ্বব্যাংকেও বোধহয় আগের মতো অর্থকড়ি জমা নেই! লালবাত্তি কম-বেশি সবারই জ্বলছে। আমার জামা-কাপড়েও এসেছে লাল সুতার রিফু।’
‘সবুজ বাত্তি থাকবে কী করে, আপনারা অর্থ খালাস না করলে! হালখাতার অনুষ্ঠানেও এলেন না এবার। কত জিলাপি ফেলে দিতে হলো সেদিন। এখন কিছু মালকড়ি অন্তত ছাড়–ন।’
‘দেবো রে ভাই, দেবো। একটু সবুর করেন। মেওয়া পাকুক।’
‘ঠিক আছে, আপা। দেওয়ার হাত প্রসারিত করেন। আমাদেরও ভদ্রলোক হয়ে থাকতে দেন।’
খুব ব্যস্ততা আছে এমন ভাব করে বেরিয়ে এলেন মোকাব্বির আলম। বলা যায় না- এ লোক কিছুক্ষণ পর হয়তো আবার ভাবি ডেকে বসবে। তারপর নানি-দাদি কিংবা মাওই ডাকাটাও অস্বাভাবিক নয়!
লকডাউন সত্ত্বেও বাজারভর্তি মানুষ। গিজগিজ করছে পঙ্গপালের মতো। তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে সওদাপাতি খরিদ করা গেলো। বাসায় ফিরে স্বস্তি মতো সেগুলো রাখতেও পারলেন না। তার আগেই বড় মেয়ে সানিয়া মোবাইল ফোন বাড়িয়ে দিলো- ‘বাবা, মামা কথা বলবেন। লাইনে আছেন।’
ফোনের ঊর্ধ্বাংশ চাপা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বলে দে, আমি বাসায় নেই। ডেঙ্গুজ্বরে মেডিকেলে ভর্তি আছি।’
‘আমি বলেছি, তুমি বাসায় থাকো এখন। এর আগে মা জানিয়েছে, সুস্থ আছো!’
সদা সত্য কথা বলিবে জাতীয় বাক্য তিনি কখনোই ছেলেমেয়েদের শেখাননি। তবুও এরা এমন হলো কেন কে জানে! স্ত্রীও তার মতোই বাস্তববাদী, মিথ্যা বুদ্ধিসম্পন্না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোকাব্বির ফোন কানে ঠেকান- ‘হ্যালো, খালেক! তোমাকে আমি একটু পরেই কল করতাম।’
‘সেই সময় কি আপনার আছে, দুলাভাই! কেমন চলছে; ব্যস্ততা কমেনি?’
‘এই তো চলছে, নুনে-আটায়।’
‘আমাদের তাও চলছে না। লকডাউন সব শাটডাউন করে দিয়েছে। আপনাকে যে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম তিন বছর আগে, এবার যদি টাকাগুলো পরিশোধ করতেন, উপকার হতো।’
‘পাওনা অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত। কিন্তু…।’
‘গাড়ির চাকা বন্ধ। আসা-যাওয়ার দরকার নেই। বিকাশ করে দেন। আমার নম্বরটা পার্সোনাল।’
‘সবকিছুর বিকাশই তো রুদ্ধ হয়ে আছে। আমরা চাইলেও কি সবকিছু সহসা স্বাভাবিক করতে পারবো। অর্থনীতির সব দরজাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানো, উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন বন্ধ!’
‘বিকাশে সমস্যা হলে রকেটে দেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোকাব্বির- ‘রকেটের গতিতেই তো দেশটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। একদিকে পদ্মাসেতু, অন্যদিকে মেট্রোরেল। আরো কত মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সর্বনাশা করোনা রকেট গতিকে এভাবে থামিয়ে দেবে- কেউ ভাবতে পারেনি কখনো!’
শ্যালক বাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ওপারে- ‘বুঝেছি, আপনার বিকাশে সমস্যা, রকেটেও ঝামেলা। তাহলে নগদে দেন। আমি বাইরে গিয়ে তুলে নেবো।’
‘বর্তমানে মৃত্যুটাই নগদ। বাকি সব শূন্য। এই তো গত পরশু পাশের বাসার কলেজপড়–য়া ছেলেটা মারা গেলো। কী যে ভালো ছেলে ছিলো; দেখা হলেই হাসি হাসি মুখ করে সালাম দিতো। এমন নগদানগদি কারবার আমরা আর কোন কালে দেখতে…।’
এতটুকু বলে থেমে গেলেন মোকাব্বির। ওই পাশ পুরোপুরি নিস্তব্ধ। খুশিই হলেন, খালেকের বোধহয় ব্যালেন্স শেষ! পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলার পরপরই খেয়াল করলেন, তার স্ত্রী শিরিন কখন যেন সামনে লাল চা রেখে গেছে। করোনা ও গরমের প্রাদুর্ভাবে গরম চা ভীষণ উপাদেয়।
এর পর মোবাইল ফোন বন্ধ রাখলেন ক’দিন। স্থগিত করলেন বাইরে যাওয়াও। আশপাশের লোকজন জ্বালাচ্ছে ভীষণ। সবারই চাই চাই, নাই নাই রব। এদিকে স্ত্রী বলছে তাকে নতুন শাড়ি কিনে দিতে হবে। শপিংমল চালু হয়ে গেছে। করোনামুক্ত পরিবেশে বিক্রি হচ্ছে দেশি-বিদেশি পোশাক, গয়নাগাটি। এ সুযোগ শুধু করোনাকালের জন্য। দামও সাশ্রয়ী। স্ত্রীর গঞ্জনার মধ্যেই এলো বাড়িওয়ালার গঞ্জনাজনক বার্তা- চলতি মাসেই সমুদয় ভাড়া পরিশোধ করতে হবে!
বাইরের বেহুদা গঞ্জনার চেয়ে বাসায় থেকে শুয়ে-বসে বাংলাদেশ টেলিভিশন ওরফে বিটিভি দেখা অনেক আরামের। সময় না কাটলে তুচ্ছ কারণে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন। এভাবেই কেটেছে কিছুদিন। তবে আরাম বেশি দিন সইলো না। দুঃসংবাদটা এলো হঠাৎ বজ্রপাতের মতো- সাধারণ ছুটি আর বাড়ছে না। এখন থেকে সবকিছু চলবে সীমিত আকারে! ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া নিয়ে চালু হয়েছে গণপরিবহনও। তব্দা-লাগা অবস্থায় মোকাব্বির আলম তাকালেন জিঞ্জিরা এলাকা থেকে সুলভ মূল্যে কেনা নানা রঙের মাস্কগুলোর দিকে। এ মুখোশ- দ্য মাস্ক কি পারবে তাকে বাইরের শতেক বাধা ও বালা-মুসিবত থেকে সঠিকভাবে সুরক্ষা দিতে!
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!