রূপকথার গল্পে থাকে একটা রাজ্য। রাজা, রানী আর একজন রাজপুত্র। রাজপুত্রেরা সবসময় রাজকন্যার খোঁজে বের হয়। তারপর রাক্ষস খোক্কসের সঙ্গে লড়াই করে। যুদ্ধে জিতে যায়। তারপর রাজপ্রাসাদে সাত শত চৌদ্দ দিন বিয়ের উৎসব হয়।
এই গল্পটা রূপকথার। তবে অন্যরকম রূপকথা। রাজ্যের নাম রমনা পার্ক। রাজপুত্রের নাম ফেলু। রাজা নাই। রানী আছে। তবে রানীর নাম আমরা জানি না। তার কোনো নাম নেই।
আমাদের এই রানী মা থাকেন গাছতলায়। পলিথিনের ঝুপরি তার ছাদ। মাটির মেঝে। ইট হলো বালিশ। গাছতলায় তাদের সংসার। সংসারে দুজন মানুষ। ফেলু আর তার মা। ময়না বুড়ি নামে এক বুড়ি আছে। সেও সঙ্গে থাকে। এই বুড়ির সঙ্গে ফেলুর পরিচয় হয় হাইকোর্ট মাজারে। বুড়ি ভিক্ষা করছিল। হাতে লাঠি। ঠুকঠুক করে হাঁটে। ফেলুকে দেখে বলে- আমারে ধর। আমার হাঁটতে বড় কষ্ট।
ফেলু বুড়ি দাদুর হাত ধরে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে আসে পার্কের ভেতর। বকুল গাছতলায়। বুড়ি খুব খুশি হয় ফেলুর মাকে দেখে। ফেলুর মা বলে- বুড়ি মা এই সংসারে কে আছে তোমার।
– মাগো কেউ নেই আমার।
– আমারও তো কেউ নেই। তাহলে এখানেই থেকে যাও বুড়ি মা।
তারপর থেকে বুড়ি মা ফেলুদের সঙ্গেই থাকে। সারাদিন সে ভিক্ষা করে সন্ধ্যাবেলায় ফেলুর মায়ের হাতে তুলে দেয়। ফেলুর মা অন্য বাসায় কাজ করে। সকালে বের হয়। দুপুরের পর একটা চটপটির দোকানে কাজ করে। সন্ধ্যায় রান্না করে কাঠের চুলো জ্বালিয়ে। পাতা কুড়িয়ে চুলো জ্বালানো হয়। রাতে ওরা তিনজন এক সঙ্গে টিনের থালায় ভাত খায়। বুড়ি মা একেক দিন একেকটা জিনিস কিনে আনেন ফেলুর জন্য। কোনোদিন খাবার। কোনোদিন খেলনা।
দাদির কাছ থেকে এই সামান্য উপহার পেয়ে শিশুর মতো খুশি হয়ে ওঠে ফেলু।
রাতে খোলা আকাশের নিচে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ওরা ঘুমায়। ভোরবেলা উঠে পার্কের পুকুরে গোসল করে নেয়। তারপর ফেলু মিয়া সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। সেদিন টিএসসির মোড়ে একঝাঁক আপার সঙ্গে দেখা হলো। একজন আপু বলল এই ছেলে তোর পায়ে জুতা নেই কেন?
ফেলু হাসে।
– আমরা গরিব মানুষ জুতা পামু কই।
সেই আপারা পরদিন ফেলুর জন্য একজোড়া জুতা নিয়ে আসে। ফেলু খুব খুশি। লাল জুতা। সেটা পায়ে দিতেই মনটা আনন্দে ভরে যায় ফেলুর।
সেদিন রাতে জুতা পায়ে দিয়ে ফেলু ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন ফেলু জুতা পায়ে বকুল গাছতলায় দাঁড়ালো। তারপর বিড়বিড় করে একটা ছড়া পড়ল-
আয় রে আয় তুতু
পায়ে লাল জুতু।
মারব তোকে গুঁতু
আমি যাব যেইখানে
জুতু যাবে সেইখানে।
ছড়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর গায়ে চড়ে দামি জামা কাপড়। অর্থাৎ ফেলু এখন রাজপুত্র। তারপর দুই হাত দিয়ে জোরে তালি দিল। আর অমনি বদলে গেল সবকিছু।
‘কি খাইবা? কই যাইবা?
জলদি কইরা কও
তুমি আমার দখিন বাতাস
প্রিয় মানুষ হও।’
অমনি শোঁ করে শব্দ হলো। আর ফেলু উড়ে উড়ে চলল তেপান্তরে।
ফেলু এখন রাজপুত্র। সে এসেছে তেপান্তরে। সঙ্গে তার পঙ্খীরাজ ঘোড়া। কোমরে একটা বড় তলোয়ার। পঙ্খীরাজ থেকে নামতেই ভারি অবাক হয়ে গেল ফেলু। কী সুন্দর দেশ। ছবির মতো আঁকা। চার পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড় যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সবুজ রঙের পাহাড়। ফেলু হাঁটতে হাঁটতে এলো ক্ষীর নদীর ক‚লে। পুরো নদীটা দুধের ননীতে ঢাকা। নদীর ক‚লে নানা ধরনের গাছ। কোনো গাছে রসগোল্লা ঝুলছে। কোনো গাছে আঙুর, আপেল। কোনো গাছে মুড়কি মোয়া। এসব দেখে ফেলুর মনটা খুশিতে আনন্দে ঝকমক করে উঠল। এত খাবার সে জীবনেও চোখে দেখেনি। খুশিতে নাচতে মন চাইল।
ক্ষীর নদীর ক‚ল থেকে এক মুঠো ক্ষীর খেলো সে। আহা এমন ক্ষীর জীবনে কেউ খায়নি। এক চুমুক খেয়েই তার মায়ের কথা মনে পড়ল। এমন ক্ষীর মাকে আর দাদিকে খাওয়াতে পারলে ওরা খুব খুশি হবে।
ফেলু ভাবতে থাকে কীভাবে এই খাবারগুলো মায়ের জন্য নেবে। জামার পকেটে সে রসগোল্লা ভরতে লাগল। তখনই হাসির শব্দ শুনতে পেল।
কে হাসে?
এদিক ওদিক তাকায় ফেলু।
দেখল আপেল গাছের পাশে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে হাসছে।
– তুমি হাসছো কেন?
– তোমার কাণ্ড দেখে
– কেন?
– এভাবে কেউ রসগোল্লা নেয়? কেউ এখান থেকে কিছু নিয়ে যেতে পারে না।
– কেন?
– তা তুমি নিজেই টের পাবে।
– তুমি কে?
– আমি তেপান্তর দেশের রাজকন্যা।
– তোমার বাবা?
– কোথায় আছে জানি না।
– তোমার খারাপ লাগে না?
– লাগে…
– এখানে কার কাছে থাকো?
– সে অনেক দুঃখের কাহিনী। আমি তো বন্দি রাজকন্যা। এই দেশের রাজার নাম রাক্ষস রাজা। খুব ভয়ঙ্কর রাজা। সে যদি টের পায় তুমি এখানে এসেছ তাহলে কি ঘটবে তোমার কপালে কেউ জানে না।
ফেলু বলল- এসব আমি একদম ভয় পাই না। রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই হবে। তারপর বোঝা যাবে কে কত সাহসী।
– রাক্ষসের সঙ্গে তুমি করবে লড়াই? হায়রে বাচ্চা ছেলে? তুমি তো একটা পুঁচকে ছেলে। রাক্ষস তোমাকে বাম হাতে ধরবে আর কপাৎ করে গিলে খাবে।
ফেলু আর কথা বাড়ালো না।
সে আপন মনে রসগোল্লা পেড়ে পকেটে ভরতে লাগল। রসগোল্লা ফেলুর খুব প্রিয়। কিন্তু ও তো গরিব মানুষ। রসগোল্লা কেনার পয়সা পাবে কোথায়?
রাজকন্যা ফেলুর কাজকর্ম দেখে হেসে গড়াগড়ি খায়।
– এই ছেলে জানো তো তেপান্তরে কোনো জিনিস কখনো শুকায় না। বসন্ত এই দেশে কখনো চলে যায় না।
শুনে খুব অবাক হলো ফেলু। তারপর মনে মনে বিড়বিড় করে করে বলল- এইবার রমনা পার্কে ফিরে গিয়ে মা আর দাদিকে নিয়ে তেপান্তরে এসে পড়ব। আর কোথাও যাব না।
হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ…
হাউ মাউ খাউ
হাউ মাউ খাউ
বিকট চিৎকার। রাক্ষস থপথপ করে হেঁটে হেঁটে আসছে।
তার বাম হাতে একটা তালগাছ উপড়ে নিয়েছে। বিশাল পাহাড়ের মতো লোমশ শরীর।
হাঁটছে। যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
হাউ মাউ খাউ… কেরে তুই। আমার রাজ্যে কেন? কতদিন মানুষ ধরে খাই না। মানুষ খুঁজে পাই না। আজ দুপুরের খাবার তোকে দিয়েই সারবো।
রাজকন্যা দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। তার মনটা ভীষণ খারাপ। আহারে পুচ্চি ছেলেটা। এক লহমায় সে রাক্ষসের পেটে চলে যাবে।
– কি রে নাতনি আমার, ও কি তোকে ফুঁসলিয়ে কোথাও নিয়ে যাবে? কি কথা বলল তোর সঙ্গে?
– কোনো কথা হয়নি দাদু।
– বেশ বেশ এই ছোকরা দেখতে পাচ্ছিস একটা আস্ত তালগাছ আমার হাতে। তোকে ডান হাতে তুলে নেব। তারপর টুপ করে মুখের ভেতর চালান করে দেব।
– এত সোজা নয় রাক্ষস দাদু। ছোট বলে অবহেলা কোরো না। আমারও শক্তি সাহস আছে। বুঝলে?
রাক্ষস এবার হুঙ্কার দিল। ধুলোর ঝড় উড়ল চারপাশে।
– কী এত বড় সাহস। আমার সঙ্গে মুখে মুখে কথা।
ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল রাক্ষস। এখনই কল্লাটা চেপে ধরবে ফেলুর।
কিন্তু সেই ফুরসত পাওয়া গেল না। ফেলু ততক্ষণে ছড়া আউড়েছে-
হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে চাই
প্রাণটা খুলে হাসতে চাই
লাফাই। ঝাঁপাই
দুনিয়া কাঁপাই
রাক্ষস দাদু
দ্যাখো আমার জাদু।
আর অমনি লাল জুতোর সাহায্যে ফেলু শূন্যে ঘুরতে লাগল। রাক্ষসের নাকে চিমটি কাটল। রাক্ষসের চোখের সামনে দিয়ে দুপাক ঘুরে নিল। রাক্ষস জোরে জোরে চিৎকার করছে – তোর মুণ্ডু খাব। তোর মুণ্ডু খাব।
কিন্তু ফেলুকে ধরতে পারছে না। ফেলু শূন্যে ভাসছে আর হাসছে। সে এক মজার ঘটনা। রাজকন্যা প্রথমটা হতবাক হয়ে রইল। তারপর হিহি করে সেও হাসতে থাকে।
রাক্ষস তখন মহাউত্তেজিত। ছেলেটিকে ধরা যাচ্ছে না। সে মহাসুখে নাকের ডগায় উড়ে বেড়াচ্ছে।
রাগে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করতে লাগল রাক্ষস। ততক্ষণে তার চোখও বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
– নাতনি লো আমায় বাঁচা। প্রাণ ভোমরার কৌটাটা নিয়ে আয়।
– কোথায় আছে কৌটা?
– আমার কোমরে খুঁতির সঙ্গে বাঁধা।
রাজকন্যা গিয়ে কৌটাটা বের করল। একছুটে সেটা দিল ছেলেটার হাতে।
– রাক্ষস তুই অনেক অত্যাচার করেছিস। এখন তুই আমাদের হাতে মারা যাবি।
রাক্ষস শুনে গর্জন করতে থাকে। কিন্তু ভোমরাটাকে তখন হাতের মুঠোয় নিয়েছে ফেলু। এখন সে উড়ে উড়ে ঘুরতে লাগল রাক্ষসের পাশে।
– এই নে তোর হাত কাটলাম।
ফেলু ভোমরার হাত ছিঁড়ে ফেলল।
– এইবার তোর পা।
ভোমরার পা ছিঁড়তেই রাক্ষস কাতর স্বরে মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগল।
– এইবার তোর মুণ্ডু খসাবো রাক্ষস।
ভোমরার মাথাটা ছিঁড়তেই চিৎকার থেমে গেল। বিশাল রাক্ষসটা ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মতো নিথর পড়ে রইল।
রাক্ষসটা মরে গেছে!
মেয়েটা বিশ্বাসই করতে পারছে না। রাজার একমাত্র মেয়ে সে। রাক্ষস তাকে ধরে এনে তেপান্তরে বন্দি করে রেখেছে। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে রাজা-রানীর কি অবস্থা কে জানে।
রাজকন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে ফেলু বলল- আমাকে ঠিকমতো ধরে রাখো। তারপর ফেলু ছড়া পড়তে লাগল-
হাওয়ায় ভেসে
আমরা যাব
অচিন দেশে।
এক দুই তিন
এক দুই তিন।
আমরা যাব রাজপ্রাসাদে
রাজার কাছে
রাজার সাথে কথা আছে।
অমনি বাতাসে ঘূর্ণি উঠল। শোঁ শোঁ শব্দ হলো। মুহূর্তের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছলো অচিন দেশের রাজপ্রাসাদে।
আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রাজা আনন্দে কাঁদতে লাগল। রানীও অন্দর মহল থেকে ছুটে এলেন। তারপর রাজপ্রাসাদে শুরু হলো উৎসব।
রাজা ফেলুকে বললেন- তুমি আমার রাজ্যে থেকে যাও। আমার মেয়েকে তুমি উদ্ধার করেছো, আমি তোমাকে হারাতে চাই না।
– কিন্তু আমার এখন বাসায় ফিরতে হবে।
– কোথায় বাসা?
– রমনা পার্কে।
রাজা বুঝতে পারলেন না। রমনা পার্ক কোথায়। বললেন- যাও তবে শিগগির ফিরে এসো। রাজকন্যার জীবন বাঁচিয়েছো। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার সঙ্গে বিয়ে হবে আমার মেয়ের। ফেলু বলল- রাজা আমার তো থাকার জায়গা নেই। বিয়ে করে আমি আমার বউকে কোথায় রাখব?
রাজা হাসলেন। তারপর বললেন- আরে বোকা আমার তো একটাই মেয়ে। এই রাজ্যও তখন তোমার হবে। বুঝলে?
ফেলু কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে- আগে মায়ের কাছে যাই। তারপর বলব কি করব আমি।
রাজপ্রাসাদের ছাদে গিয়ে ছড়া পড়তে লাগল ফেলু-
রমনা পার্কে ফিরে যাই
তাই তাই তাইরে নাই
মা কাঁদে
দাদি কাঁদে
তাদের মুখে ফোটাই হাসি
আমি তাদের ভালোবাসি।
তখন রমনায় রাত নেমেছে। অনেক গভীর রাত। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর উদাস হয়ে খোলামাঠে বসে রইল ফেলু। রসগোল্লার স্বাদ যেন জিভে লেগে আছে।
কোথায় গিয়েছিলাম আমি? কেন এতকিছু ঘটল? যা ঘটেছে তা কি সত্যি!
মায়ের কোলের কাছে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল ফেলু। পরনে লাল জুতাটা আছে।
কিন্তু জুতার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই ফেলুর। মাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
আমীরুল ইসলাম
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!