মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সঙ্গীতজগতের এক অগ্রগণ্য গায়ক ও সুরকার। ১৯৫০-এর দশকে জনপ্রিয়তা অর্জন করে তিনি আধুনিক বাংলা গানে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তার কণ্ঠ ছিল স্বতন্ত্র, যা সহজেই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার দখল ছিল দুর্দান্ত, যা তার গানে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হত। গান রচনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, যেখানে তিনি গানের কথা ও সুরকে অসাধারণভাবে একসঙ্গে মেলাতে পারতেন।
বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ
১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশককে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট শিল্পীদের উপস্থিতিতে বাংলা গান এক অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এই সময়ে বাংলা গানের জগতে অসংখ্য কালজয়ী গান সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গানগুলোর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।
প্রাথমিক জীবন ও সঙ্গীত যাত্রা
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন তার কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকেই তিনি কীর্তন, ভজন ও ভক্তিগীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তার কাকা ছিলেন উচ্চমানের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ, যার ফলে ছোট থেকেই মানবেন্দ্র সঙ্গীতের গভীর জগতে প্রবেশ করেন।
১৯৫৩ সালে তার প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়— “নাই চন্দন লেখা শ্রীরাধার চোখে নাই নাই শ্যাম রাই”। এরপর তিনি এইচএমভি’র মাধ্যমে দুটি গান রেকর্ড করেন— “ফিরে দেখো না” এবং “জানি না তুমি কোথায়”। শ্যামল গুপ্তের লেখা “এমনি করে পড়বে মনে” এবং আধা-শাস্ত্রীয় ধাঁচের “ঘুমায়োনা সখী গো” গান দুটিও শ্রোতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়।
শীঘ্রই তিনি তৎকালীন বিখ্যাত সুরকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাসগুপ্ত, রবিন চট্টোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, অভিজিৎ ব্যানার্জি, প্রভৃতি।
জনপ্রিয় গানসমূহ
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ও সুরে অনেক গান আজও জনপ্রিয়। তার কিছু উল্লেখযোগ্য গান হলো:
- “আমি পরিনি বুঝিতে পরিনি” (সলিল চৌধুরীর সুর)
- “যদি জানতে” (সলিল চৌধুরী)
- “ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে” (সুধীন দাসগুপ্ত)
- “তোরি চুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে” (সুধীন দাসগুপ্ত)
- “জদি আমাকে দেখো তুমি উদাসী” (অভিজিৎ ব্যানার্জি)
- “সেই চোখ কোথায় তোমার” (অভিজিৎ ব্যানার্জি)
- “বিরহিণী চিরো বিরহিণী” (হিমাংশু দত্ত)
- “এই নীল নির্জন সাগরে” (প্রবীর মজুমদার)
এছাড়াও, তিনি দুর্গাপূজার অমর সংগীত “তব অচিন্ত্য রূপ চরিত মহিমা” গানটি গেয়েছিলেন, যা আজও শ্রোতাদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।
চলচ্চিত্র সঙ্গীত জীবন
চলচ্চিত্র সঙ্গীতেও মানবেন্দ্র ছিলেন অনবদ্য। তিনি ১৯৫৪ সালে “চম্পাডাঙ্গার বউ” সিনেমার মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালনায় হাতেখড়ি নেন, যেখানে গান লিখেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত সিনেমা “লালু ভুলু”-তে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তার গাওয়া গানগুলো ছিল জনপ্রিয়—
- “যার হৃদয় আকাশের নীল নীলিমায়”
- “দুঃখ আমার শেষ করে দাও প্রভু”
- “সূর্য তোমার সোনার তোরণ খোলো”
এছাড়াও “নীলাচলে মহাপ্রভু” সিনেমার জন্য তিনি রাইচাঁদ বড়ালের সুরে “জগন্নাথ জগত বন্ধু” কীর্তন গানটি গেয়েছিলেন, যা তৎকালীন দর্শকদের বিমোহিত করেছিল।
সঙ্গীত পরিচালনা
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজেও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- “মায়ামৃগ” (১৯৬০)
- “বধূ” (১৯৬২)
- “জয়জয়ন্তী” (১৯৭০)
- “গোধূলি বেলায়” (১৯৬৫)
- “সুদূর নীহারিকা” (১৯৭৮)
তিনি শাস্ত্রীয় ঘরানার অনেক গানকে চলচ্চিত্র সঙ্গীতে অনবদ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেমন—
- “সজনী বিনা রজনী না যায়” (সঙ্গীত: অনিল বাগচী, সিনেমা: শশীবাবুর সংসার)
- “অন্ধারে” (সঙ্গীত: জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সিনেমা: বসন্ত বাহার)
পরবর্তী জীবন ও উত্তরাধিকার
১৯৭০-এর দশকে তিনি “এই গঙ্গা এই পদ্মা”, “হাজার জনম ধরে”, “হালকা মেঘের পালকি”-র মতো জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি নজরুলগীতি ও বাগবাজারের গান পরিবেশন শুরু করেন।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নজরুলগীতির ক্ষেত্রেও বিশাল প্রভাব রেখেছেন। তার গাওয়া “বাগিচায় বুলবুলি তুই”, “মুসাফির মোছ রে আঁখি জল”, “আমার নয়নে কৃষ্ণ নয়ন তারা” গানগুলো অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনেকের মতে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি, যেমনটা বাংলা সঙ্গীতের অনেক মহান শিল্পীর ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তবে তার গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
ব্যক্তিগত জীবন
তিনি বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের কন্যা মানসী মুখোপাধ্যায়ও একজন সুপরিচিত গায়িকা।
বাংলা আধুনিক গানের জগতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার গাওয়া ও সুরারোপিত গানগুলো আজও বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তার কণ্ঠস্বর, সুরের গভীরতা, ও গানের বহুমাত্রিকতা তাকে বাংলা সঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী করে তুলেছে।