ভাটিয়ালি: বাংলা গানের ঐতিহ্য

রায়হান চৌধুরী
6 মিনিটে পড়ুন

ভাটিয়ালি একটি অসাধারণ এবং হৃদয়গ্রাহী লোকসঙ্গীত যা প্রধানত বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গাওয়া হয়। এটি এক ধরনের নদী সঙ্গীত, যা সাধারণত নৌকাবালা নাবিকরা নদীর স্রোতে চলতে চলতে গেয়ে থাকেন। “ভাটিয়ালি” শব্দটি বাংলা ভাষার “ভাটা” (ভাটা) শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “নদীর স্রোত” বা “নদীচলন”। এই সঙ্গীতের মূল চরিত্র নদীজীবনের সাথে গাঁথা, যেখানে মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।

এই নিবন্ধে, আমরা ভাটিয়ালি সঙ্গীতের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং আধুনিক সংস্করণের বিবর্তন সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করব। ব্রহ্মপুত্র নদী এলাকার মৌলিক উৎপত্তি থেকে শুরু করে, বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী সংগীত উৎসবে তার জনপ্রিয়তা – ভাটিয়ালি সঙ্গীত মানুষের মনে এক অমোঘ স্থান দখল করে রেখেছে।

ভাটিয়ালির উৎপত্তি এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ভাটিয়ালি সঙ্গীতের উৎপত্তি ঘটেছে মূলত বাংলার নদী অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর কাছাকাছি ময়মনসিংহ অঞ্চলে। যদিও কিছু গবেষক ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভাটিয়ালির মূল উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এই সঙ্গীতটি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নদীপ্রান্তের অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। এই নদীসমূহের পরিবেশ এবং জীবনধারা ভাটিয়ালির জন্ম এবং তার পরবর্তী বিকাশের জন্য এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল।

ভাটিয়ালি সঙ্গীত সাধারণত নদীর মাঝি বা নৌকাবালা নাবিকরা গেয়েছেন যখন তারা নদী পথে নৌকা চালাচ্ছিলেন। এরা নদীর স্রোতের সাথে নিজেদের জীবনকে তুলনা করে, নিজেদের আবেগ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহ এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের কথা গানেই প্রকাশ করতেন। সুর ও বাণীতে নদীর অবিচল স্রোতের সাথে জীবন এবং সময়ের প্রবাহের একটি গভীর সংযোগ রয়েছে।

- বিজ্ঞাপন -

ভাটিয়ালি এবং বাংলা লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্য

ভাটিয়ালি বাংলা লোকসঙ্গীতের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি বাংলা লোকসঙ্গীতের “প্রকৃতিতত্ত্ব” (প্রকৃতি) শাখার অন্তর্গত, যা বাংলা সঙ্গীতের ১৪টি প্রধান শাখার মধ্যে একটি। অন্যান্য শাখাগুলির মধ্যে “দেহতত্ত্ব” (শরীর) এবং “মুর্শিদতত্ত্ব” (গুরু সম্পর্কে) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভাটিয়ালির সুর এবং বাণী প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ককেই প্রতিফলিত করে, যা বাংলার লোকসংগীতের মূল বিষয়।

ভাটিয়ালি গানের মূল বিষয়বস্তু হলো নদী, মাঝি, নৌকা এবং গুণ (যাত্রা)। এই সঙ্গীতের গানগুলি মানুষের অন্তরঙ্গ অনুভূতিগুলির প্রতিফলন হিসেবে তৈরি হয়, যেমন ভালোবাসা, বিরহ, একাকিত্ব এবং জীবনের সংগ্রাম। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, নদী এবং নৌকার সাথে মানুষের সম্পর্কও প্রধানভাবে এই গানে ফুটে ওঠে।

ভাটিয়ালি সঙ্গীতের বিখ্যাত শিল্পী এবং স্রষ্টারা

ভাটিয়ালি সঙ্গীতের ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত শিল্পী, রচয়িতা এবং স্রষ্টা অবদান রেখেছেন। মিরাজ আলী, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, জালাল খান, জং বাহাদুর, শাহ আবদুল করিম, এবং উমেদ আলী এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে (১৯৩০-১৯৫০) ভাটিয়ালি সঙ্গীত তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে এবং সংগীতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গান রচিত হয়।

এবং সঙ্গীতের ইতিহাসে, আব্বাস উদ্দিন তার জনপ্রিয় গান “আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে” এর মাধ্যমে ভাটিয়ালীকে একটি বড় শ্রোতাপ্রিয় সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার গানগুলি ভাটিয়ালির জন্য একটি সোনালী সময়ের সূচনা করেছিল।

আধুনিক যুগে, মালয় গঙ্গোপাধ্যায় এবং বরি সিদ্দিকী ভাটিয়ালির অনন্য সঙ্গীতকলা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও সায়েরাভ মনী, একজন আন্তর্জাতিক ভাটিয়ালি শিল্পী, যিনি দক্ষিণ বাংলার ভাটিয়ালির বিশেষ শৈলী নিয়ে মূল সঙ্গীতকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছেন, তার অসাধারণ কাজের মাধ্যমে।

- বিজ্ঞাপন -
ভাটিয়ালি
Opening Song – Bangla Wikipedia National Seminar and Workshop – Hijli College – West Midnapore 2015-09-28 4184” by Biswarup Ganguly is licensed under CC BY 3.0

ভাটিয়ালি এবং প্রকৃতির সম্পর্ক

ভাটিয়ালি গানের মূল বিষয় হলো প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক। এটি নদী, জীবন এবং মানুষের আবেগের মধ্যে সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠা করে। নদীর স্রোত সমুদ্রের দিকে চলতে থাকে, যেমন জীবনের প্রবাহ অবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে এবং সময় চলে যায়।

একটি ভাটিয়ালি গানে দেখা যায়:

“তরী ভাট্যায় পথ আর উজান না”
(নৌকা নদীর স্রোতে চলতে থাকে, আর উজান দিকে চলে না)

- বিজ্ঞাপন -

এটি জীবন এবং নদীর স্রোতের মধ্যে সমান্তরাল তৈরি করে, যেখানে উজান মুখী হবার কোনো সুযোগ নেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত একবার চলে গেলে তা ফিরে আসে না। নদীর স্রোতের প্রবাহ, যেমন তা কখনই উজান দিকে ফিরে আসে না, তেমনি জীবনের পথও একদিকেই চলে।

আধুনিক ভাটিয়ালি: পরিবর্তন এবং অভিযোজন

ভাটিয়ালি সঙ্গীত সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও পুরানো ভাটিয়ালি গানগুলিতে জীবন, প্রকৃতি, বিরহ এবং একাকিত্বের গহন অনুভূতি ফুটে উঠেছিল, আধুনিক ভাটিয়ালি গানগুলি কিছুটা বেশি বাস্তবভিত্তিক হয়েছে। বর্তমানে, নদী মাঝিরা নদী পথে যাত্রা করে, ব্যবসায়িক সঙ্গীতের ছোঁয়া তুলে এনে গান গাইছেন, যেখানে তারা পণ্য বিক্রি, লাভ-লোকসান এবং বিভিন্ন ধরনের নদী ব্যবসার কথা গানেই বলে থাকেন।

এছাড়াও, নদীকে স্রোতের প্রতীক হিসেবে ধরে ভাটিয়ালি এখন আধুনিক জীবনের আরো অনেক দিক নিয়ে গান রচনা করছে, যেমন জীবনের সংগ্রাম, সামাজিক এবং আর্থিক বাস্তবতা।

ভাটিয়ালির চিরন্তন ঐতিহ্য

ভাটিয়ালি শুধুমাত্র একটি সঙ্গীত শৈলী নয়, এটি বাংলা নদীমাতৃক মানুষের জীবনধারা, প্রকৃতি এবং অন্তর্নিহিত অনুভূতির প্রতিফলন। নদী, মাঝি এবং গতি – এই সমস্ত উপাদানই ভাটিয়ালিকে একটি সুরের মাধ্যমে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তৈরি করেছে। এটি একটি জীবন্ত সঙ্গীত রূপ যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একে অপরকে সংযুক্ত করে রাখে, বাংলার মানুষের অস্তিত্ব, ভালোবাসা, বিরহ এবং সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আজও, পৃথিবীজুড়ে ভাটিয়ালি সঙ্গীত তার শাশ্বত সুরের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে চলেছে, এবং এই ঐতিহ্য বহনকারী সঙ্গীতটি বিশ্বব্যাপী নতুন প্রজন্মের কাছে সমাদৃত হচ্ছে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!