কাওয়ালি: এক সুরেলা আধ্যাত্মিক যাত্রা

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

কাওয়ালি একটি বিশেষ ধরনের সুফি ইসলামী ধর্মীয় সঙ্গীত যা ভারতের উপমহাদেশে উদ্ভূত হয়েছিল। মূলত সুফি দরগাহে (সমাধি) ধর্মীয় উপাসনার অংশ হিসেবে এই সঙ্গীত পরিবেশিত হত। তবে আজকাল এটি পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানে জনপ্রিয়, এবং ২০শ শতাব্দীর শেষ দিকে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত জগতেও এর প্রবেশ ঘটেছে।

কাওয়ালি সঙ্গীতের মূল লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহর স্মরণে একটি আধ্যাত্মিক এবং সুরেলা অভিজ্ঞতা প্রদান করা। এটি সুফি আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য অঙ্গ, যা শোনার মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সঙ্গে ঐক্যের অনুভূতি লাভ করতে পারে। কাওয়ালি সঙ্গীতের ইতিহাস, প্রথা এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

কাওয়ালি কী?

কাওয়ালি শব্দটি আদি আরবি শব্দ ‘কওল’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘উচ্চারণ’ বা ‘বলার’। কাওয়ালি এক ধরনের সঙ্গীত যা সাধারণত একটি দলের মধ্যে পরিবেশিত হয়, যেখানে সুর, কবিতা এবং আধ্যাত্মিকতা একত্রে মিলে এক অভূতপূর্ব সুর তৈরি করে। সাধারণত এই সঙ্গীতের মাধ্যমে আল্লাহর মহিমা গাওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে একটি গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়।

কাওয়ালির ইতিহাস ও উত্স

কাওয়ালি সঙ্গীতের জন্ম ভারতের দিল্লি শহরের সুফি সাধক আমির খসরো দ্বারা, যিনি ১৩শ শতাব্দীতে সুফি তরিকার আধ্যাত্মিক গান এবং কবিতা পদ্ধতি একত্রিত করে এই সঙ্গীতের সূচনা করেন। খসরো ছিলেন চিশতী তরিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং তিনি সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কাওয়ালি তৈরি করেন।

- বিজ্ঞাপন -

প্রথম দিকে কাওয়ালি সঙ্গীত ছিল পুরোহিতদের আধ্যাত্মিক প্রার্থনা, এবং কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো না। তবে পরবর্তীতে সঙ্গীতের সাথে হারমোনিয়াম, তবলাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই প্রথা সূচনা করেছিলেন সুফি সাধকরা, যাদের পরামর্শে সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়।

কাওয়ালির মৌলিক দিক

কাওয়ালি সঙ্গীতের মূল বিষয় হলো প্রেম, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক কাঙ্ক্ষা। সুফি কবিরা এই গানের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক প্রেম এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে ফুটিয়ে তোলেন। প্রেমের কবিতা, মদ, মাতালতা এবং মরমি অনুভূতি কাওয়ালিতে এক অনন্য রূপে উপস্থাপিত হয়। যদিও এ সবকে প্রথাগতভাবে ধর্মীয় নির্দেশনা হিসেবে দেখা হয়, এগুলো বাস্তব জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রতি এক গভীর আকর্ষণের প্রকাশ।

কাওয়ালি
Qawwali singers at Fatehpur sikri, India.” by Nagarjun Kandukuru is licensed under CC BY 2.0

কাওয়ালির প্রধান সংগীতজ্ঞরা

কাওয়ালি সঙ্গীতের একজন কিংবদন্তি শিল্পী ছিলেন নুসরাত ফতেহ আলী খান, যিনি কাওয়ালি সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি দেন। এছাড়াও আখলাক হুসেন, আবিদা পারভীন, রাহাত ফতেহ আলী খান, ফারিদ আয়াজ, সাবরি ব্রাদার্স এবং আমজাদ সাবরির মতো অসংখ্য সঙ্গীতজ্ঞ কাওয়ালি সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

কাওয়ালি পার্টির সংগঠন

কাওয়ালি একটি দলের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়, যা সাধারণত আট বা নয় সদস্য নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে থাকে প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ, সাইড সঙ্গীতজ্ঞ, হারমোনিয়াম এবং তবলাবাদক। প্রতিটি পারফরম্যান্সে প্রথমে একটি প্রস্তাবনামূলক সুর পরিবেশন করা হয়, এরপর শুরু হয় মূল গান, যা সাধারণত অনেক বেশি উত্সাহ এবং উত্তেজনার সাথে পরিবেশিত হয়।

কাওয়ালি এবং বাদ্যযন্ত্র

প্রথমদিকে কাওয়ালি সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্র ছাড়া পরিবেশন করা হতো, কিন্তু বর্তমানে হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোলকসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র কাওয়ালির অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। কাওয়ালি গানগুলি সাধারণত রাগা ভিত্তিক হয় এবং এগুলির মাঝে আবেগের উচ্চতা এবং তীব্রতা আসে যা শ্রোতাদের এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত করে।

- বিজ্ঞাপন -

কাওয়ালি সংগীতের সংগঠন ও কার্যক্রম

কাওয়ালি পারফরম্যান্স শুরু হয় সাধারণত একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রস্তাবনা দিয়ে, তারপর আস্তে আস্তে মূল গান শুরু হয় এবং সঙ্গীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সঙ্গীতের মেলডি এবং সুরের পরিবর্তন ঘটানো হয়, যা শ্রোতাদের কাছে এক বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে। সঙ্গীতের তীব্রতা এবং আবেগের সাথে কাওয়ালরা নিজের সঙ্গীতের মাঝে গভীর সঙ্গীতান্বিত ধারায় প্রবাহিত হন।

কাওয়ালি এবং বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা

বিশ্বের নানা প্রান্তে কাওয়ালির জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বিশেষ করে নুসরাত ফতেহ আলী খানের অনন্য সঙ্গীতের মাধ্যমে। কাওয়ালি এখন শুধুমাত্র পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ নেই, এটি আন্তর্জাতিক সংগীত জগতেও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।

কাওয়ালি সঙ্গীত আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক প্রেম, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি এক গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এটি শুধু একটি সঙ্গীতের ধরন নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে একটি নতুন আলোকবর্তিকা নিয়ে আসে। কাওয়ালি আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শোনা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে মানবজীবনের গভীরতা এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তির অনুভূতি আরও দৃঢ় হচ্ছে।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!