যাত্রা: ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকনাট্য ধারা

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

যাত্রা, একটি প্রাচীন ভারতীয় লোকনাট্য ধারা, যা পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, অসম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। এটি একটি সঙ্গীত, নৃত্য এবং নাট্যধর্মী উপস্থাপনা যার মূল উদ্দেশ্য দর্শকদের বিনোদন প্রদান। প্রাচীন ধর্মীয় প্রচলন থেকে শুরু হয়ে, বর্তমানে এই লোকনাট্য শিল্প দেশের বিভিন্ন স্থানে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাত্রার ইতিহাস, তার ধারা ও পরিবর্তনসহ, এই শিল্পের বিবর্তন এক চমৎকার সাহিত্যের গল্প তৈরি করে।

যাত্রার উৎপত্তি

যাত্রার উৎপত্তি সম্পর্কিত তথ্যসমূহ ধর্মীয় ইতিহাসে শিকড় গেড়ে রয়েছে। মূলত এটি ভক্তিমূলক নাট্যধারা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার ভক্তদের সাথে রামকৃষ্ণের কাহিনী প্রর্দশিত করতে গিয়েছিলেন ১৫০৭ সালে, এই সময়ে প্রথমভাবে যাত্রার উৎপত্তি ঘটে। চৈতন্য ভগবত দর্শন ও শ্রীকৃষ্ণের কাহিনীকে সঙ্গীত ও নাট্য মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, মধ্যযুগে বাংলায় ‘নাট গীত’ বা অপেরা নাট্য রূপের ধারণা ছিল, যা পরবর্তীতে যাত্রার উদ্ভব ঘটায়।

যাত্রার বৈশিষ্ট্য

যাত্রা নাটক সাধারণত চার ঘণ্টার দীর্ঘ সময়জুড়ে মঞ্চস্থ হয়। এ ধরনের নাটকে উচ্চ শব্দ, চমৎকার আলো, এবং বিশাল মঞ্চ ব্যবহৃত হয়। নাটকের উপস্থাপনা অত্যন্ত নাটকীয় এবং অতিনাটকীয় ভাবভঙ্গির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যেখানে আবৃত্তি, নৃত্য এবং সঙ্গীতের সংমিশ্রণ থাকে। যাত্রার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর মঞ্চে, প্রায়শই পুরুষ অভিনেতারা মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, তবে ১৯ শতক থেকে মহিলাদের অভিনয় যোগ হওয়ার পর, এই ধারা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।

যাত্রার উন্নতি ও পরিবর্তন

১৯ শতক পর্যন্ত যাত্রা মূলত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে এটি আরও সম্প্রসারিত হয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নাট্যকর্ম সৃষ্টি করেছে। আজকের যাত্রায় বিভিন্ন প্রসঙ্গ যেমন: মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, সাম্প্রতিক রাজনীতি এবং সমাজের বাস্তবতা উঠে আসে।

- বিজ্ঞাপন -

পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে কলকাতার বাগবাজারে স্থাপন করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি এবং ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চ। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাত্রার শিল্পকে আরও আধুনিক ও উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে, যাতে এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে আরও জনপ্রিয় হতে পারে।

যাত্রার সামাজিক ভূমিকা

যাত্রা শুধুমাত্র একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি। এক সময় গ্রামাঞ্চলে যাত্রা একটি জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। বর্তমানে এটি শহরেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বিশেষ করে উৎসবের সময় বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে যাত্রার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এবং এটি তাদের সামাজিক বার্তা দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম।

যাত্রা
Dhanu jatra” by AkkiDa is licensed under CC CC0 1.0

বাংলাদেশের যাত্রা সংস্কৃতি

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে, বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে যাত্রার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানে যাত্রার গান যেমন “মহুয়া সুন্দরী”, “খাইরুন সুন্দরী”, “রূপবান”, “কৃষ্ণলীলা” ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাংলাদেশের যাত্রা সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তবে এর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যেমন স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা ও প্রথার ব্যবহার।

যাত্রার বিভিন্ন চরিত্র

যাত্রার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার চরিত্র গঠন। যাত্রার বেশিরভাগ চরিত্র আলংকারিক বা উপমা দিয়ে তৈরি হয়। এর মধ্যে “বিবেক” বা “বিবেকী” চরিত্রটি সবথেকে উল্লেখযোগ্য। এই চরিত্রটি একটি নৈতিক রক্ষকের ভূমিকা পালন করে এবং দৃশ্যপটের মাধ্যমে চরিত্রের কর্মের ফলাফল ব্যাখ্যা করে। এছাড়া “নিয়তি” বা “কর্মফল” চরিত্রও গুরুত্বপূর্ণ, যেটি ভবিষ্যত বা বিপদের পূর্বাভাস প্রদান করে থাকে।

যাত্রার শিল্পী ও প্রস্তুতি

যাত্রার অভিনেতারা সাধারণত ছোটবেলা থেকেই এই শিল্পে প্রবেশ করেন। তাদের অভিনয় দক্ষতা বিচার করা হয় তাদের কণ্ঠশক্তি এবং ডায়ালগ ডেলিভারির উপর, কারণ এই উপস্থাপনাগুলিতে শব্দের উচ্চতা এবং আবেগময় এক্সপ্রেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাত্রার পরিবেশনায় সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট আসবাবপত্র ব্যবহার করা হয় না; বরং মঞ্চটি একটি খালি জায়গা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে নাটকীয়তার জন্য সবকিছু স্থাপন করা হয়।

- বিজ্ঞাপন -

যাত্রার সঙ্গীত ও নৃত্য

যাত্রার সঙ্গীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গীতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নৃত্য পরিবেশনা এবং শাস্ত্রীয় রাগ ভিত্তিক গান যাত্রাকে একটি ঐতিহ্যবাহী এবং মার্জিত শিল্প হিসেবে তুলে ধরে। সঙ্গীতের মধ্যে নানা ধরনের যন্ত্র যেমন: ঢোলক, পাখাওয়াজ, হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, সিম্বল, বেহালা এবং ক্ল্যারিনেট ব্যবহৃত হয়। এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই যাত্রার পরিবেশনা আরও জীবন্ত এবং দর্শককে আকর্ষিত করে।

যাত্রা ও আধুনিক পরিবর্তন

আজকের দিনে যাত্রা বিভিন্নভাবে আধুনিকায়িত হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতি ও নাট্যশিল্পের পরিবর্তনের সাথে সাথে, যাত্রার মঞ্চে আধুনিক আলোর ব্যবস্থা, বড় পর্দার ব্যবহারের মাধ্যমে নাটকীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, একদিকে যেমন এটি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হয়েছে, তেমনি এটি তার ঐতিহ্যবাহী আদব-কায়দা ও সঙ্গীতের প্রতি অনুগত থেকেছে। এটি এক সাংস্কৃতিক যাত্রার প্রতীক, যা প্রাচীন শিল্পধারা এবং আধুনিক বিশ্বকে একত্রিত করে।

যাত্রা, যা একসময় শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের অংশ ছিল, তা আজকের দিনে শিল্প ও বিনোদনের এক উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই ধারা, যার মূল ভিত্তি সংস্কৃতি, সঙ্গীত, নাটক এবং নৃত্য, তা আজও সারা ভারত এবং বাংলাদেশের গ্রাম-শহর সব জায়গায় জনপ্রিয়। যত দিন যাবে, যাত্রা তার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখে, নতুন আঙ্গিকে আরও আধুনিক এবং সমৃদ্ধ হবে।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!