ডা. অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন অন্যতম ভারতীয় বাঙালি নজরুলগীতি গায়িকা, যিনি তার সঙ্গীত কৌশল ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছিলেন। শুধু সঙ্গীত জগতেই নয়, চিকিৎসক হিসেবেও তার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার জীবন সঙ্গীত এবং চিকিৎসার মধ্য দিয়ে একজন অনন্য পথিকৃৎ হয়ে ওঠে।
শৈশব এবং পরিবার
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টোপাধ্যায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যা ছিল একটি সঙ্গীতপ্রেমী ও ঐতিহ্যবাহী পরিবার। তার বড় ভাই শিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রানাঘাটের নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও তার শিষ্যদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভকারী একজন খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী। এই পরিবারে সঙ্গীত ছিল এক প্রকার ঐতিহ্য, এবং অঞ্জলির জীবনে সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা স্বাভাবিকভাবেই জন্মেছিল।
অঞ্জলি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। শিক্ষায় তিনি যেমন ছিলেন অসাধারণ, তেমনি খেলাধুলাতেও তার দক্ষতা ছিল। তিনি টেবিল টেনিসে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হন। তবে, সঙ্গীত ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেম।
শিক্ষা এবং চিকিৎসক জীবনে পদার্পণ
কলকাতায় এসে অঞ্জলি ডাক্তারি পড়াশোনা শুরু করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি বি এস ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি লন্ডনে ‘রয়্যাল কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ান এবং গাইনোকোলজিস্ট’ (MRCOG) থেকে বিশেষজ্ঞের ডিগ্রি অর্জন করেন। চিকিৎসা পেশায় তিনি ক্যালকাটা হসপিটালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একজন অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তবে, তার জীবনে সঙ্গীতের ভূমিকা কখনও কম ছিল না। চিকিৎসক হিসেবে সফলতার পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতি তার নিষ্ঠা তাকে এক অনন্য স্থানে পৌঁছায়।
সঙ্গীত জীবন এবং নজরুলগীতি
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত জীবন শুরু হয় তার বড় ভাই শিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা নিয়ে। পরবর্তীতে তিনি সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা এবং আঙুরবালার কাছ থেকেও তালিম নেন। ষাটের দশকে তিনি নজরুলগীতির ক্ষেত্রে তার দক্ষতা প্রদর্শন করতে শুরু করেন এবং খুব তাড়াতাড়ি এই ক্ষেত্রের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
১৯৫৬ সালে তার প্রথম গান হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানির মাধ্যমে রেকর্ড হয়, যা তার সঙ্গীত ক্যারিয়ারের সূচনা ঘটায়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে তিনি একের পর এক নজরুলগীতি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, গজল এবং লোকগানের রেকর্ডিং করেন। তার গানের শৈলী ছিল একদম অনন্য এবং তার কণ্ঠস্বর ছিল গভীর এবং হৃদয়স্পর্শী।
সঙ্গীতের প্রতি অবদান এবং সঙ্গীতজ্ঞদের প্রশিক্ষণ
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় শুধু একজন গায়িকা ছিলেন না, বরং তিনি সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েও অনেক শিল্পীকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রস্তুত করেছেন। কবি নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী শেলী রায়চৌধুরী এবং তার কন্যা ইন্দ্রাণীসহ আরও অনেক শিল্পী তার কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা নিয়েছিলেন।
চিকিৎসক হিসেবে অবদান
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের চিকিৎসক জীবনও ছিল অত্যন্ত গৌরবময়। তিনি একটি স্বনামধন্য গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তার দক্ষতা ও মানবিকতার জন্য তিনি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে অসংখ্য রোগীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের জীবন সঙ্গী ছিলেন অজিত মুখোপাধ্যায়, যিনি তাকে তার সঙ্গীত এবং চিকিৎসক জীবনে সবসময় সমর্থন দিয়েছিলেন। তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর এবং তারা একে অপরের পেশাগত জীবনকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
মৃত্যু এবং অবদান
১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর, মাত্র ৫২ বছর বয়সে, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় মারা যান। তার মৃত্যু বাংলা সঙ্গীত জগতের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি ছিল, তবে তার সঙ্গীত ও চিকিৎসা জগতের প্রতি অবদান আজও অম্লান।
অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের গানের মধ্যে নজরুলগীতি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, গজল, এবং লোকগীতির মিশ্রণ ছিল, যা তার শিল্পীসত্তার একটি বিশাল পরিসর তৈরি করেছিল। তিনি বাংলার সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং তার গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে জীবন্ত।
ডা. অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি সঙ্গীত ও চিকিৎসায় একযোগে সফলতা অর্জন করেছিলেন। তার সঙ্গীত, তার চিকিৎসা পেশা, এবং তার সংস্কৃতির প্রতি অবদান বাংলা জাতির জন্য অমূল্য রত্ন। তিনি শুধুমাত্র একটি গায়িকা বা চিকিৎসক নন, বরং তিনি ছিলেন এক অনুপ্রেরণা, যিনি তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের সেবা করেছেন এবং সংস্কৃতির প্রতি তার অবিচলিত ভালোবাসা দিয়ে আমাদেরকে প্রেরণা দিয়েছেন।