অনিল বিশ্বাস (৭ জুলাই ১৯১৪ – ৩১ মে ২০০৩) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। তিনি পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রাসঙ্গীত ও বাংলার লোকসঙ্গীতের সংযোগে ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের বিশেষ উন্নতিসাধন করেছিলেন। বাদ্যবৃন্দ ও বৃন্দগানের ক্ষেত্রেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে তার নিরবচ্ছিন্ন অবদানের কারণে ভারতীয় চলচ্চিত্র মহলে তাকে ‘পিতামহ ভীষ্ম’ আখ্যা দেওয়া হয়।
জীবনের প্রথম দিক
অনিল বিশ্বাসের জন্ম ১৯১৪ সালের ৭ জুলাই বরিশালের একটি ছোট্ট গ্রামে। শৈশবে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন এবং অনেকবার জেলে যান। তার পড়াশোনা ছিল মাঝখানে বিঘ্নিত হলেও সঙ্গীতের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে কলকাতায় টেনে আনে। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় আসেন এবং মেগাফোন কোম্পানির সাথে যুক্ত হন। এখানে তিনি প্রতি পাঁচ টাকায় গানের সুর তৈরির কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি রঙমহল থিয়েটারে যোগ দেন এবং সেখানে গান, অভিনয় ও অর্কেস্ট্রা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।
সঙ্গীত জীবনের উত্থান
১৯৩৫ সালে তিনি ইস্টার্ন আর্টস ব্যানারে সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন। তার প্রথম সঙ্গীত পরিচালিত ছবি ছিল “ধর্ম কী দেবী” (১৯৩৫)। এরপর “জাগিরদার”, “গ্রামোফোন সিঙ্গার” এবং “মহাগীত” এর মতো হিট ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক যিনি টুয়েলভ পিস অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করেছিলেন। তার সুরারোপিত ছবিগুলির মধ্যে “আরাম” (১৯৫১), “কিসমত” (১৯৪৩), “পহেলি নজর” (১৯৫৪) এবং “ওয়ারিশ” (১৯৫৪) আজও জনপ্রিয়।
বিশেষ অবদান
অনিল বিশ্বাস সঙ্গীতের জগতে পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার প্রথম ব্যবহারকারী ছিলেন এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার নতুন ধারার সূচনা করেন। তিনি ভারতীয় রাগের ভিত্তিতে সুর রচনা করতেন, যা তার সঙ্গীতকে বিশেষভাবে আলাদা করেছে। তিনি প্লে-ব্যাক সিঙ্গিং এরও এক পিওনি ছিলেন, এবং বহু বিখ্যাত গায়ক যেমন মুকেশ ও তালাত মাহমুদ তার সুরে প্রথম প্লে-ব্যাক গান গেয়েছিলেন। তার সুরে সঙ্গীত নির্মাণ করার কারণে বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
অনিল বিশ্বাস প্রথম বিয়ে করেন অভিনেত্রী আশালতা বিশ্বাসের সাথে, যিনি পরে “মেহরুননিসা” নামে পরিচিত হন। তবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৫৪ সালে। এরপর তিনি গায়িকা মীনা কাপুরকে বিয়ে করেন। তাদের কোনো সন্তান না হলেও মীনা কাপুর তার সাথে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন।
অবসর জীবন
১৯৬৩ সালে তিনি বোম্বাই থেকে দিল্লিতে চলে যান এবং আকাশবাণীতে প্রধান প্রযোজকের পদে নিয়োগ পান। তিনি সঙ্গীতের প্রতি তার ভালোবাসা আর শেষ সময় পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন। মৃত্যুর আগে, ২০০৩ সালে তিনি কিছু পুরনো গান রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
মৃত্যুঃ
অনিল বিশ্বাস ২০০৩ সালের ৩১ মে দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী তাকে “ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের একজন মহানায়ক” হিসেবে আখ্যা দেন এবং তার সঙ্গীতের অবদানকে অমর বলে ঘোষণা করেন।
তার সৃষ্ট চলচ্চিত্রগুলি
অনিল বিশ্বাসের সুরারোপিত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে:
- আরাম (১৯৫১)
- অঙ্গুলিমাল (১৯৬০)
- অনোখা প্যার (১৯৪৮)
- দো রাহে (১৯৫২)
- গজরে (১৯৪৮)
- কিসমত (১৯৪৩)
- পহেলি নজর (১৯৫৪)
- ওয়ারিশ (১৯৫৪)
সঙ্গীতের বিশেষত্ব
অনিল বিশ্বাসের সঙ্গীতের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার অর্কেস্ট্রাল ব্যবহারে বিশেষ দক্ষতা। তিনি প্রথম ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে “টুয়েলভ পিস অর্কেস্ট্রা” ব্যবহার করেন, যা তার সঙ্গীতকে বিশ্বমানের একটি স্থানে নিয়ে যায়। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় লোক সঙ্গীতের মিশ্রণে সঙ্গীত তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল ছিলেন।
অনিল বিশ্বাসের অবদান ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। তার সৃষ্ট সঙ্গীত ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং তার সুর এখনও শ্রোতাদের মনে জীবন্ত রয়েছে।