রবীন্দ্রসঙ্গীত: একটি শিল্প, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মহাসম্মিলন

রায়হান চৌধুরী
5 মিনিটে পড়ুন

রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত এবং সুরারোপিত গান, বাংলা সংগীতের একটি অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত। বাংলা সংগীতের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের অবদান অপরিসীম। তার সৃষ্ট গানগুলো কেবলমাত্র সঙ্গীতের দিক থেকে নয়, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথা এবং সুরে এক অবর্ণনীয় ঐক্য এবং সুর-তাল-মাত্রার অদ্বিতীয় মেলবন্ধন রয়েছে, যা তাকে একজন সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে অমর করেছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের উৎপত্তি এবং প্রথম গান

রবীন্দ্রনাথের প্রথম রচিত গানটি ছিল “গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে”। এই গানটি গুরু নানকের একটি ভজনের বঙ্গানুবাদ হিসেবে রচিত। রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক সঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তার সুরের বৈশিষ্ট্য এবং নতুনত্ব প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিনি গানের সুরে যে ধরনের আধুনিকতা এনেছিলেন তা পরবর্তী সময়ের বাংলা সংগীতের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।

গানের সুর ও শব্দের মেলবন্ধন

রবীন্দ্রনাথের গানগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার সুরের সরলতা এবং গানের শব্দের গভীরতা। তাঁর সুরে ছিলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব, কিন্তু তা ছিলো একেবারে নতুন আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি বাংলার লোকসঙ্গীত, কীর্তন, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং বাউল গানগুলোকে একত্রিত করে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন।

সুরের ধারা ও প্রভাব

রবীন্দ্রনাথের সুরের মধ্যে ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তরানা, ভজন প্রভৃতি ধারা মিশ্রিত ছিল। সঙ্গীতের সুরে এক ধরনের অব্যক্ত অনুভূতি, যে অনুভূতি গানের মধ্যে প্রবাহিত হতে হতে শ্রোতার অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো শ্রোতাদের মনের গভীরে প্রবেশ করে তাদের ভাবাবেগকে প্রভাবিত করতো। এই গানগুলোতে ছিল অদ্ভুত রস, যা কেবল সুরেই নয়, ভাষায়ও প্রতিফলিত।

- বিজ্ঞাপন -

গীতবিতান: রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন

রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গান একত্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় ‘গীতবিতান’ নামক সংকলন গ্রন্থে। এটি রবীন্দ্রনাথের গানের একটি অমূল্য সংগ্রহশালা। গীতবিতান গ্রন্থে তিনি তার গানগুলোকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন যেমন: পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ইত্যাদি। এই গানগুলির মধ্যে প্রতিটি গানের পেছনে রয়েছে গভীর দর্শন এবং মানবিক অনুভূতি, যা শুনলে শ্রোতা যেন এক নতুন জগতে প্রবেশ করে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের দার্শনিক প্রভাব

রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে তার সাহিত্যিক দর্শন এবং জীবনদৃষ্টিরও প্রতিফলন ঘটেছিল। তার গানে যেমন বৈষ্ণব সাহিত্য, বাউল দর্শন, এবং উপনিষদের প্রভাব ছিল, তেমনি ছিল তার নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার গভীরতা। এই গানগুলো মানুষের অন্তরের গভীরে প্রবাহিত হতো এবং শ্রোতাদের আত্মিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করতো।

চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার

বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারের ইতিহাসও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয় ১৯৩৭ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত চলচ্চিত্র মুক্তি তে। এরপর সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষসহ বহু আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান পরিচালক তাদের ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন। তাদের ছবির সুর, শিল্প এবং কাহিনীর মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারের মাধ্যমে এক অদ্ভুত একাত্মতা সৃষ্টি হয়েছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত
Dance with Rabindra Sangeet – Kolkata 2011-11-05 6716” by Biswarup Ganguly is licensed under CC BY 3.0

রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজনৈতিক প্রভাব

রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার গানগুলো ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে। বিশেষ করে “জনগণমন অধিনায়ক জয় হে” এবং “আমার সোনার বাংলা” গান দুটি যথাক্রমে ভারত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচিত।

বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের আইনগত বিতর্ক

রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপারে একাধিক আইনগত বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৫১ সালের ভারতের কপিরাইট আইন অনুসারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশ করতে হলে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। তবে, দেবব্রত বিশ্বাসের মতো শিল্পীরা বিশ্বভারতীর অনুমতি না নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা বিতর্কের জন্ম দেয়।

- বিজ্ঞাপন -

রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক-গায়িকাদের অবদান

রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা এবং তার সংগীতের চিরকালীন জীবন্ত উপস্থিতি রয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত শিল্পীর কল্যাণে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, গীতা ঘটক প্রমুখ শিল্পীরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাঁদের গায়কিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাঙালি সমাজের বিভিন্ন স্তরে সমাদৃত হয়েছে। পাশাপাশি, লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে প্রমুখ বলিউড শিল্পীরাও রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন, যার ফলে এই গানগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি লাভ করেছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত কেবল একটি সঙ্গীত ধারাই নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাংলা ও বাঙালির আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই গানগুলো শুধুমাত্র সঙ্গীতের মাধ্যমে নান্দনিক তৃপ্তি দেয় না, বরং এর মধ্যে রয়েছে মানবিক চেতনা, দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং সংস্কৃতির গভীরতম অনুভূতি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক একটি গান যেন একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা যুগে যুগে নতুন নতুন প্রজন্মের কাছে তার সৃষ্টিশীলতা, ভাবনা ও শক্তি সঞ্চারিত করে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!