কম সময়ে কার্যকর উদ্ধার অভিযান

ফয়সাল কবির
ফয়সাল কবির - ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
8 মিনিটে পড়ুন

সাময়িকী.কম

দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন 
021735opatetion kalerkantho pic 0 কম সময়ে কার্যকর উদ্ধার অভিযান
গুলশানের রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি লোকজনকে উদ্ধারে গতকাল (২ জুলাই) সকালে যৌথ বাহিনীর অভিযান।
– ছবি : সাবের হোসেন চৌধুরীর টুইট থেকে 

আবুল কাশেম  | 
৩ জুলাই, ২০১৬




২০০৮ সালের নভেম্বরে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের তাজ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলসহ পাঁচটি স্থাপনায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে জিম্মি করে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা। সেই জিম্মিদশা থেকে বন্দিদের মুক্ত করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লেগেছিল চার দিন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের ‘ব্ল্যাক টর্নেডো’ নামের ওই অপারেশনে নিহত হয় ১৬৪ জন এবং আহত হয় ৩০৮ জন। অভিযানে হামলাকারীদের সাতজন নিহত হয়েছিল।  চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজনপুরে একদল ডাকাত জিম্মি করে রেখেছিল পুলিশের ২৪ সদস্যকে। প্রায় ২১০০ পুলিশ সদস্য সাত দফা অভিযান চালিয়েও তাঁদের সতীর্থদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হন। এসব অভিযানে আরো সাত সঙ্গীকে হারায় পাকিস্তান পুলিশ। জিম্মিদশার ১৮ দিনের মাথায় সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল সাঁজোয়া যানবাহন নিয়ে অভিযান চালিয়ে জিম্মি পুলিশ সদস্যদের মুক্ত করে। ওই সময় ৪০ জন ডাকাত আত্মসমর্পণ করে। 

জিম্মি করার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও বন্দুকধারীরা জিম্মি করে দেশটির নাগরিকদের। সেখানে কোথাও কোথাও দ্রুততম সময়ে সফল অভিযান পরিচালনা করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনায় সময় লেগেছে অনেক বেশি। ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ‘আমেরিকান সিভিক অ্যাসোসিয়েশন ইমিগ্রেশন সেন্টার’-এ ভিয়েতনামের বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান নাগরিক ক্লাসরুমে ঢুকে তার সাবেক শিক্ষক ও ছাত্রদের জিম্মি করে। এক দিনের ওই জিম্মির ঘটনায় ১৩ জনকে হত্যা করে ওই সন্ত্রাসী। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর সময়ই আত্মহত্যা করে সে। ১৯৭৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে জিম্মি সংকট কাটাতে অভিযান পরিচালনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের সময় লেগেছিল ৩৯ ঘণ্টা। 
download কম সময়ে কার্যকর উদ্ধার অভিযান

কিন্তু জিম্মি সংকট দূর করতে পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকলেও বাংলাদেশের এত বেশি সময় লাগেনি। দেশে প্রথমবারের মতো এমন জিম্মি সংকট দূর করতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সফলভাবে। বিপুল আয়োজন ছিল সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সফল এই অভিযানে প্রাণহানিও ঘটেছে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জিম্মি ঘটনা ঘটে গত শুক্রবার রাত পৌনে ৯টায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। অতীতে এ ধরনের জিম্মিদশা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর সময় লেগেছে মাত্র ১১ ঘণ্টা। এই অল্প সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দক্ষ কমান্ডোরা ঢাকায় এসেছেন, প্রস্তুতি সেরেছেন। এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও জঙ্গিরা সায় দেয়নি তাতে। ফলে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে কমান্ডোদের। এতে প্রাণ গেছে ছয় সন্ত্রাসীর। জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তিন বিদেশিসহ ১৩ জনকে। আর যে ২০ জন দেশি-বিদেশি নিহত হয়েছে, তাদের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে জিম্মি করার পরপরই। সফল অভিযানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারা কমান্ডোসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামে পরিচালিত এই অভিযান পরিচালনার আগের প্রস্তুতিসহ সার্বিক ঘটনা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জিম্মি ঘটনার অভিযানে বিভিন্ন রকম ফল পাওয়া গেছে। তবে বেশির ভাগ জিম্মি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করেছে। ফলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে অনেক সময় লাগলেও প্রাণহানি কম হয়েছে। আবার গুলশান ট্র্যাজেডির মতো জিম্মি ঘটনাও অনেক রয়েছে, যেখানে স্বল্পতম সময়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হলেও বিপুল প্রাণহানি রোধ করা যায়নি। সে তুলনায় জিম্মিদশা ভাঙার প্রথম অভিজ্ঞতায় বেশ সফলতা দেখিয়েছে সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির জিম্মি সংকট নিরসনে গতকাল শনিবার সকালে কমান্ডো অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযান যে সফল হয়েছে তা স্পষ্ট হয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একটা সফল অভিযান করার জন্য আমি আমাদের প্রথম প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, বিমানবাহিনীর সবাইকেই। সারা রাত কাজ করে এই অল্প সময়ের মধ্যে অপারেশন চালানোর ফলেই আমরা সন্ত্রাসীদের খতম করতে সক্ষম হয়েছি।’ 

প্রধানমন্ত্রী জানান, অভিযানের জন্য সিলেট এবং সাভার থেকেও সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের ঢাকায় আনা হয়েছিল। গণভবনে বসে রাত জেগে পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। রাত ৪টা বেজে যায় অপারেশনের পরিকল্পনা করতে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সেনা, নৌসহ বিভিন্ন বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেখিয়ে বলেন, তাঁরা রাত জেগেছেন। সকালে অভিযান শুরু হয়। অল্প সময়ে অপারেশন হয়েছে।  

রাজধানীর গুলশানের রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের মধ্যে গতকাল রাতেই ২০ জনকে হত্যা করা হয়। ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গতকাল সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান শেষে ঘটনাস্থলে তল্লাশিকালে এসব জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। 

গতকাল দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা সদরের অফিসার্স মেসে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক  ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী। 

ব্রিগডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ‘অভিযানের মাধ্যমে আমরা তিনজন বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তাদের মধ্যে দুজন শ্রীলঙ্কান ও একজন জাপানি নাগরিক। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া অভিযান শেষে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, যাদের ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে নৃংশসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নাঈম আশফাক চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ১ জুলাই (শুক্রবার) রাত প্রায় সোয়া ৮টায় গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে প্রবেশ করে এবং রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ কর্ডন করে সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-র‍্যাব ও বিজিবি যে সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারি প্রদর্শন করেছে, তা অনন্য। দুজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় নিহত হন। আহত হন আরো ২০ জন। এ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে অভিযান পরিচালনার জন্য সরকারপ্রধান আদেশ দেন। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনী গতকাল রাত থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‍্যাব সহযোগে সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল ৮টায় অপারেশনের সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হননি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, গুলশানে জিম্মিকারী সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা হয়নি। র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ শুক্রবার রাতে জিম্মি ঘটনার পরপরই সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সন্ত্রাসীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তা আমলে নেয়নি সন্ত্রাসীরা। বরং বিদেশিদের হত্যা করে বাংলাদেশে নিজেদের উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে সন্ত্রাসীরা। ফলে শুক্রবার মধ্যরাতেই ২০ বিদেশি জিম্মিকে হত্যা করে তাদের লাশের ছবি ইন্টারনেটে তুলে ধরা হয়। এ ধরনের জিম্মি সংকটে প্রাণহানি স্বাভাবিকভাবেই বেশি ঘটে। কিন্তু সকালেই মাত্র ৫০ মিনিটের অপারেশনে সন্ত্রাসীরা পরাস্ত হয়। 

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
অনুসরণ করুন:
কর্মজীবী এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!