ব্যাকরণের যে কয়টি অংশ খটমট নয়, বরং বেশ মজার, সেগুলোর একটি এই বাগধারা। বাগধারা বিষয়টাই এমন যে, বলা হয় একরকম, কিন্তু বোঝায় আরেক অর্থ। বাগধারার সংজ্ঞাও কিন্তু এটাই। একটি বা কয়েকটি শব্দ বাক্যে একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে শব্দগুলোর সাধারণ অর্থ প্রকাশ না করে বিশেষ কোনো অর্থ প্রকাশ করলে, শব্দটিকে বা শব্দগুলোকে বলা হয় বাগধারা।
ব্যাকরণের খটমট ভাষায় বললে, কোনো শব্দ বা শব্দ-সমষ্টি বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে অর্থের দিক দিয়ে যখন বৈশিষ্ট্যময় হয়ে ওঠে, তখন সে সকল শব্দ বা শব্দ-সমষ্টিকে বাগধারা বা বাক্যরীতি বলা হয়। কিংবা বলা যায়, আক্ষরিক অর্থ ছাপিয়ে যখন কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে বাগধারা বা বিশিষ্টার্থক শব্দ বলে।
বাগধারার জন্ম হয় মুখেমুখে। সাধারণত কোনো ঘটনা থেকেই জন্ম হয় বাগধারার। কোনো একটা ঘটনা মানুষের মনে দাগ কাটলে, মানুষ তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায়-ও সেই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে আনে। আর তখনই জন্ম হয় বাগধারার।
যেমন, এক অলস লোকের গল্প ছিল। সে ভীষণ অলস। এত অলস, নড়তেও যেন কষ্ট হয়। একদিন সে খেজুর গাছের নিচে শুয়ে ছিল। তখন একটা খেজুর টুপ করে ঠিক তার গোঁফের মাঝখানে এসে পড়ল। জিব দিয়ে একটু কসরত করলেই খেজুরটা তার পেটে চালান করে দেওয়া যায়। কিন্তু লোকটি এতই অলস, এইটুকু পরিশ্রমেও তার ভীষণ আপত্তি। তাই সে হা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়েই থাকল। কখন খেজুরটা এমনি এমনি গড়িয়ে তার মুখে এসে পড়বে, আর সে খেজুর খাবে। সেই গল্প থেকেই মানুষ অলস লোককে বলতে শুরু করল- ‘গোঁফখেজুরে’।
সব বাগধারা কিন্তু এমন লোকগল্প থেকে এসেছে, তা নয়। অনেক বাগধারা এসেছে পুরাণ থেকেও। যেমন- অগস্ত্য যাত্রা, কুম্ভকর্ণের ঘুম, কাক ভূষণ্ডী, ঘরের শত্রু বিভীষণ, মান্ধাতার আমল, কলিকাল, রাবণের চিতা, একাদশে বৃহস্পতি, খাণ্ডবদাহন, কুরুক্ষেত্র প্রভৃতি।
অগস্ত্য যাত্রা
অর্থ: চিরদিনের জন্য প্রস্থান/ মৃত্যু
‘অগস্ত্য’ বেদের একজন ঋষির নাম। সে ‘সূর্য’ ও ‘বরুণ’-এর সন্তান। এই অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু।
একবার বিন্ধ্যপর্বতের এক অদ্ভুত ইচ্ছা হল। সূর্য তো উদয়াস্তকালে সুমেরু পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে। বিন্ধ্যপর্বতের ইচ্ছা হল, সূর্য তাকেও এভাবে প্রতিদিন প্রদক্ষিণ করবে। তখন বিন্ধ্যপর্বত সূর্যকে গিয়ে সে কথা বলল।
কিন্তু সূর্য বেঁকে বসল। তার সোজা কথা- বিশ্বনিয়ন্তা তাকে যে পথে চলতে আদেশ দিয়েছেন, সূর্য সে পথেই পরিভ্রমণ করবে। অন্য পথে সে যাবেই না।
শুনে তো বিন্ধ্যপর্বত ভীষণ রেগে গেল। রেগে গিয়ে নিজের শরীর এমনভাবে ফোলাতে-ফাঁপাতে শুরু করল, সূর্যের পথই বন্ধ হয়ে গেল।
এবার তো ভীষণ বিপদ হয়ে গেল। সূর্য তো সূর্য, দেবতারাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সবাই মিলে গিয়ে ধরল বিন্ধ্যপর্বতের গুরু অগস্ত্য মুনিকে। সব শুনে অগস্ত্য মুনি বললেন, “ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখছি।”
অগস্ত্য মুনি সোজা বিন্ধ্যপর্বতের কাছে চলে গেলেন। গুরুকে দেখেই বিন্ধ্যপর্বত একেবারে মাথা নিচু করে প্রণাম করল। অগস্ত্য মুনি তখন বললেন, “আমি দক্ষিণাপথে যাত্রা করছি। আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি, তুমি এভাবেই থাক।”
এই বলে অগস্ত্য মুনি দক্ষিণাপথে সেই যে যাত্রা করলেন, আর ফিরলেন না। সেখান থেকেই ‘অগস্ত্য যাত্রা’ অর্থ হয়ে গেল আর ফিরে না আসা। পরে সেটাই হয়ে গেল মারা যাওয়া।
কুম্ভকর্ণের ঘুম
অর্থ: অস্বাভাবিক ঘুমকাতুরে
কুম্ভকর্ণ ছিল এক রাক্ষস। সে কিন্তু যেন-তেন রাক্ষস ছিল না; রীতিমতো রাক্ষসরাজ রাবণের ভাই সে। আর ও খেতেও পারত খুব। জন্মানোর পরপরই ও হাজার খানেক প্রজা খেয়ে ফেলেছিল!
পরে অবশ্য ও ওর ভাইদের সঙ্গে গোকর্ণ আশ্রমে তপস্যায় বসল। উগ্র তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্টও করল। তারপর বর চাইল- অমরত্ব। কিন্তু ব্রহ্মা ওকে বর না দিয়েই চলে আসলেন। দেবতারাও ব্রহ্মাকে গিয়ে বললেন, কুম্ভকর্ণকে বর দিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই ও যা খায়! ততদিনে কুম্ভকর্ণ প্রচুর রাক্ষস-প্রজা আর মানুষ তো বটেই, আরও খেয়ে ফেলেছে স্বর্গের সাতজন অপ্সরী, ইন্দ্রের দশজন অনুচর আর অসংখ্য মুনি-ঋষি। বর পেয়ে অমর হয়ে গেলে তো ও ত্রিভুবন খেয়ে ফেলবে!
এদিকে কুম্ভকর্ণ আবার কঠোর তপস্যায় বসে গেছে। সে তপস্যা এমন কঠোর, পুরো পৃথিবী ভীষণ গরম হয়ে উঠল। এই যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, এমন অবস্থা! ব্রহ্মা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। শেষে ব্রহ্মা এক ফন্দি আঁটলেন। তার স্ত্রী সরস্বতীকে বললেন, কুম্ভকর্ণের কণ্ঠে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতে। ব্রহ্মা যখন কুম্ভকর্ণের কাছে বর জানতে চাইবেন, তখন কুম্ভকর্ণের বদলে সরস্বতী-ই বর চাইবেন।
তেমনি-ই হল। ব্রহ্মা বর শুনতে চাইলে কুম্ভকর্ণ বলল, ‘অনন্ত জীবন’। আর সরস্বতী কণ্ঠে ঘাপটি মেরে থেকে সেটাকে বদলে বানিয়ে দিলেন, ‘অনন্ত নিদ্রা’। ‘তথাস্তু’ বলে ব্রহ্মাও নিশ্চিন্তে বর দিয়ে দিলেন।
কুম্ভকর্ণের চৈতন্য আসার পর ওর তো মাথায় হাত! পরে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সে কী অনুনয়-বিনয়। শেষে ব্রহ্মা বর একটু পাল্টে দিলেন- ছয় মাস পরপর একদিনের জন্য কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে। অসময়ে ঘুম ভাঙলে অবশ্য কুম্ভকর্ণের মৃত্যুও হতে পারে।
এই গল্প থেকেই ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ বাগধারাটির উৎপত্তি।
কাক ভূষণ্ডী
অর্থ: দীর্ঘজীবী ব্যক্তি
কাক ভূষণ্ডী বলতে আসলে ‘ভূষণ্ডী’কেই বোঝায়। ভূষণ্ডী নিজেই কাক; সেখান থেকেই ‘কাক ভূষণ্ডী’। কিন্তু প্রশ্ন হল, দীর্ঘজীবী ব্যক্তিকে কেন কাক বলা হবে?
কারণ, পৌরাণিক এই কাকটির বিশেষত্ব হল, সে আবহমানকাল জুড়ে বেঁচে আছে। আর সেই আদ্যিকাল থেকে পৃথিবীতে আছে বলে সে পৃথিবীর সমস্ত ঘটনাই জানে।
একবার নাকি কৃষ্ণ ভূষণ্ডী, মানে কাক ভূষণ্ডীকে জিজ্ঞেস করেছিল কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ সম্পর্কে। তখন সে যা বলেছিল, সংক্ষেপে তা এরকম- সত্যযুগের শুম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধের সময় সে ছিল। কাকদের কাজই তো ময়লা-এঁটো খাওয়া। সেই যুদ্ধের সময়ও নিহত দৈত্যদের রক্ত-মাংস সে খেয়েছিল। তার একদমই কষ্ট হয়নি খেয়ে শেষ করতে। পরে ত্রেতাযুগে লঙ্কাযুদ্ধে সেসব খেয়ে শেষ করতে তার একটু কষ্ট-ই হয়ে গিয়েছিল। তবু সে তা সামলে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তার কষ্টের সীমা ছিল না।
ঘরের শত্রু বিভীষণ
অর্থ: যে স্বজন শত্রু
বিভীষণ ছিল রাবণের ছোট ভাই। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ- বিশ্রবা মুনির তিন ছেলে। ওদের মা নিকষা আবার সুমালী রাক্ষসের মেয়ে। নিকষার আরেক নাম কৈকসী।
এই সুমালী-ই তার মেয়ে নিকষাকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠায়। বিশ্রবা মুনি ধ্যান করছিলেন। নিকষা আসায় তার ধ্যান ভঙ্গ হয়। রেগে গিয়ে তিনি শাপ দিয়ে বসেন- নিকষার সব সন্তানই হবে ভীষণাকার রাক্ষস।
পরে নিকষা মুনিকে অনেক অনুনয়-বিনয় করলে, বিশ্রবা মুনি শাপ একটু কমিয়ে দেন। তার কথার তো আর নড়চড় হবে না; তবে শেষ সন্তানটি রাক্ষস হলেও ধর্মনিষ্ঠ হবে।
রাম-রাবণের যুদ্ধের গল্প তো সবার শোনা। লঙ্কার যুদ্ধ যেটা। রাবণ সীতাকে উঠিয়ে নিয়ে আসলে, রাম সীতাকে উদ্ধারের জন্য ধর্মযুদ্ধ শুরু করে দেয়। তখন রাবণের এই ধর্মনিষ্ঠ ছোট ভাই রামের পক্ষে যোগ দেয়। রাক্ষস-রাজ্যের নানা গোপন কথা ফাঁস করে করে রামকে জিততে সহায়তা করে।
বিভীষণের এই কাজ ধর্মের পক্ষে হলেও, সে কিন্তু নিজের পরিবারের সঙ্গে একরকম শত্রুর মতো আচরণ-ই করেছিল। আর তাই, ঘরের মানে পরিবারের কেউ শত্রুর মতো আচরণ করলে, তাকে বলা হয় ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’।
মান্ধাতার আমল
অর্থ: পুরনো কাল/ অনেক আগের
মান্ধাতা এক রাজার নাম। বোঝাই যাচ্ছে যে, এই রাজার রাজত্বকাল ছিল অনেক অনেক দিন আগে; আর তাই পুরনো সময়ের কথা বলতে গেলে বলা হয় ‘মান্ধাতার আমল’।
এই মান্ধাতা ছিল সূর্য বংশের রাজা যুবনাশ্বের পুত্র। রামায়ণের নায়ক ‘রাম’ও এই সূর্য বংশের রাজা ছিল। মান্ধাতার আমল বা রাজত্বকাল কত আগে ছিল, তা বোঝাই যাচ্ছে।
মান্ধাতার জন্মের ইতিহাসটা আবার খুব অবাক-করা। ওর বাবা যুবনাশ্বের কোনো ছেলে হচ্ছিল না। তখন সে মুনিদের আশ্রমে গিয়ে যোগ সাধনা করতে শুরু করল; যাতে তার একটি ছেলে হয়।
এক সময় মুনিরা তার সাধনায় সন্তুষ্ট হলেন। তখন তার ছেলের জন্য তারা এক যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। যজ্ঞ শেষ হল মাঝরাতে। তখন কলসি ভর্তি মন্ত্রপূত জল বেদিতে রেখে তারা ঘুমাতে গেলেন। কথা থাকল, এই কলসির জল যুবনাশ্বের স্ত্রী খেলে তার ছেলে হবে।
কিন্তু রাতে যুবনাশ্বের খুব তৃষ্ণা পেল। সে আর না পেরে নিজেই সে কলসির জল পান করে ফেলল।
সকালে উঠে মুনিরা পুরো ঘটনা শুনে মুচকি হেসে বলল, “সন্তান তাহলে তোমার পেট থেকেই হবে।”
তবে তারা যুবনাশ্বকে গর্ভধারণের কষ্ট থেকে মুক্তি দিলেন। একশ বছর পূর্ণ হলে যুবনাশ্বের শরীর থেকেই মান্ধাতার জন্ম হল।
পরে রাজা হয়ে মান্ধাতা পৃথিবী-বিজয়ে বের হয়। যুদ্ধ করতে করতে মান্ধাতা সারা পৃথিবী-ই জয় করে ফেলে। শেষমেশ ও পৃথিবী-বিজয় শেষ করে স্বর্গরাজ্য জয় করতে যায়। তখন ইন্দ্র ওকে বলেন, “তুমি তো এখনও পুরো পৃথিবী-ই জয় করতে পারনি। মধুর পুত্র লবণাসুর এখনও তোমার অধীনতা স্বীকার করেনি। আগে তা করে এস, তারপর স্বর্গ নিয়ে ভেব ’খন।”
লবণাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে মান্ধাতা নিহত হয়।