সাময়িকী.কম
কমল: সাক্ষাৎকার শুরুর আগে আমি একটু পাঠ স্মৃতিচারণা করি, সেটা হলো, আপনি সম্ভবত এবারই চট্টগ্রামে প্রথম আসলেন।
জয় গোস্বামী . হ্যাঁ এই প্রথম, কিন্তু এই শহরেরে অনেক ইতিহাস জানি। বিপ্লবের ইতিহাস। মাষ্টারদা কথা , তিনি চট্টগ্রামের মানুষ।
কমল: সব কবিরই দেখা যায় একটা ঘটনাময় শৈশব থাকে। গোঁসাইবাগানে দীর্ঘদিন ধরে আপনি শৈশবের ঘটনাবলি লিখেছেন। আপনার বাবার হাতেই আপনার হাতেখড়ি কবিতায়!
জয় গোস্বামী : না না, এ সত্যি না। আমার আট বছর পাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা যান। আমার মা একা আমাকে মানুষ করেন আমাকে। কবিতা লিখি আমি ১৩-১৪ বছর বয়সে। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকে লিখতে শুরু করি।
কমল : এই কথা সবাই বিশ্বাস করে- যারা কবিতার, যারা সাহিত্যের অনুরক্ত- জয় গোস্বামী বাংলা সাহিত্যে পূর্বাপর যে পরিক্রমণ, সেখানে একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছেন। এটা এক ধরনের স্তুতি হতে পারে। আমার নিজস্ব অনুভব এরকম যে, এ কথার মাঝে সত্যতা আছে। আমার নিজের অনেক ভালোলাগার কবি আপনি। তো কবিতায় আপনার জড়ানো মানে কিভাবে কবিতায় আপনার বিশেষ আবেগ এবং কবিতা কেনো আপনাকে এতো প্রবলভাবে টান দেয়?
জয় গোস্বামী: খুব সহজে একটা উত্তর এখন আমি খুঁজে পাই না। তবে যখন আমি স্কুলে পড়তাম তখন আমি আমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতাম না। খেলাধুলা করতে পারতাম না শারীরিক অসুবিধার জন্য। কিন্তু আমার কথা জানার জন্য আমি বই পড়তাম। এই মনের কথা জানার পর থেকে আত্ম-উপলব্ধি করলাম। এরপর থেকে সেগুলো একটা সময় এঁকেবেঁকে কবিতার চেহারার মধ্যে নামে। তারপর এখনো মনের কথা জানবার চেষ্টা করি। এটাই হচ্ছে মূল কথাটা।
কমল: আপনার একটা জনপ্রিয় কবিতা ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে’। ওই যে, ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে/পেয়েছি হাত সাফাইয়ের হাত/মিলেছি চোর সাধু ডাকাত/জগতের আনন্দযজ্ঞে’…সে কবিতায় আপনি শেষ দিকে এসে বলেছেন, ‘আমরা সব হারানো লোক/আকাশে ভাসিয়ে দিলাম চোখ/সাগরে ভাসিয়ে দিলাম চোখ/যা রে যা চোখ ভেসে যা দূর/আমার দূরের পলাশপুর/যেখানে বাংলাদেশের মন/ঘুমোলো মা-হারা ভাই বোন…’। এই যে বাংলাদেশের মন, পশ্চিমবঙ্গে থাকেন আপনি, বাংলাদেশ আপনার কবিতায় বারবার এসেছে, আসে, বাংলাদেশকে এতটা ধারণ করেন কিভাবে?
জয় গোস্বামী : তুমি খুব ভালো ধরেছ। ভৌগোলিক বা কাঁটাতারের সীমারেখা দিয়ে তো আর মন বেঁধে রাখা যায় না। ওই কবিতার শেষ দিকে কিন্তু আছে, ‘তখন ভেসেছে নৌকাটি/হাওয়ায় ভেসেছে নৌকাটি/তলায় বাংলাদেশের মাটি/মাটিতে আমরা কয়েকজন/আমরাই নির্ধনিয়ার ধন/পেয়েছি রাজকুমারীর মন’। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, ওই যে শামীমের এমন আতিথেয়তা, সে তো আমি বাঙালি বলেই, হয়তো দু-চার লাইন লিখি সে জন্যই। ভূগোল যা-ই বলুক না কেন, বাংলাভাষী পুরো অঞ্চলই আমার বাংলাদেশ। যে ভাষার জন্য সালাম, বরকত রক্ত দিয়েছে, সে ভাষাটা আমার। সে দেশটাও আমারই তো।
কমল: সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিকে তো সহজেই আপনার একটু বিচরণ আছে। যেমন, অনেকেই মনে করেন সাঁঝবাতির রূপকথারা আপনার কবি সত্তারই প্রকাশ। অথবা অন্য কোনোভাবে কাব্যবোধের যে উচ্চারণ সেটাই আসলে লক্ষ্য করা যায়। এখানে আমার মনে হয় যে, পূর্বাপরই আপনি যা কিছু লেখেন না কেনো, যা কিছু করেন না কেনো তার মধ্যে কবি বলতে আমাদের মনে যে ধারণার জন্ম দেয় তার একটা অভিব্যক্তি আমরা পাই। প্রকাশটা আমরা লক্ষ করি। এটা নিশ্চয়ই আপনারও লক্ষ করার বিষয়।
জয় গোস্বামী : আমি সাধারণত যে উপন্যাস লিখি এর মধ্যে শুধু রূপকথার নয়, যে কটা পর্ব আমি লিখেছি তা উপন্যাস আকারে ছাপা হয়েছে। তা লিখেছি, আমি একটা পত্রিকায় কাজ করি সেখানে যিনি সম্পাদক তিনি আমাকে লিখতে বলেছেন। প্রথম লেখার পর আমি যে এটা চালিয়ে যাব, চালিয়ে যাবার পুঁজি ছিল না আমার। তখন কাবেরী যার সঙ্গে আমি সংসার করেছি। সে বলল, বছরে কুড়ি হাজার টাকা তুমি কি অন্য কোনোভাবে উপায় করতে পারবে? আমাদের মেয়েটা ছোট। তুমি ভেবে দেখো যে, জিনিসটাকে গ্রহণ করবে কি না? আমি কিছু কিছু বছরে, একটা করে গদ্য রচনা করি যা উপন্যাস আকারে ছাপা হয়েছে, তা লিখতে থাকি। তবে সেগুলো কোনোটাই আমার উপন্যাস বলে মনে হয় না। সাংবাদিকতা করার সময় আমি যে পাড়ায় থাকতাম, সে পাড়ায় অমিতাভ ব্যানার্জী নামে একজন শিল্পী থাকতেন। তিনি দোতলায় তার কাজ করতেন। তখন তিনি বেশ বড়, তার সমস্ত চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। এখন আমার যে বয়স ওর তখন তাই বয়স। তখন গদ্যটা একদিন সকাল বেলা শুরু করলাম। তখন তিন পাতা কিংবা এক-দু পাতা লিখেছি তখন পাউরুটি কিনতে গেলাম। সকাল বেলা পাউরুটি খেতাম। পাউরুটি কিনে যখন ফিরে আসছি তখন দেখি অমিতাভ ব্যানার্জী একটা বড় ক্যানভাস হাতে করে ধরে সরিয়ে দুতলার ঘরে রাখছে। আমি দেখতে পেলাম রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়। তারপর বাড়িতে গিয়ে যখন লিখতে বসলাম আমার চরিত্রটা সেই চরিত্রকরণ হয়ে গেল।
জয় গোস্বামী : আসলে ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা’ তখনের দিনটা খুব বিশেষ ছিল। সবার কাছে হয়ত বিশেষ নয়। তখন একটা মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কলকাতার পথে পথে দুজনে কিছুক্ষণ ঘুরেছিলাম। ত্রিশ বছর আগে।
কমল: কবিতাটা দেশ পত্রিকায় যখন ছাপা হয়েছিল, তখন আমরা জানতে পারলাম যে, জয় গোস্বামী এরকম একটা ঘটনা ঘটিয়েছে।
জয় গোস্বামী : তখন আমি চাকরি করতাম না। কবিতাপত্রে বের হবার আগে প্রতিক্ষণ পত্রিকায় কবিতাটি প্রথম বের হয়েছিল।
কমল: আপনার প্রিয় কবি কারা?
জয় গোস্বামী : বাংলায় যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের সবার কবিতাই আমি পড়ি। কারো কারো কবিতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা একটু বেশি। যেমন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শঙ্খ ঘোষ। আরো অনেকে আছেন, যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি। কেউ হয়তো কম লিখেছেন ভালো লেখা, কেউ বেশি।
কমল:: আসলে মানুষের জীবন-মৃত্যু-সম্পর্ক নিয়ে কোনো ধারণা থাকে বলে আমার মনে হয় না। প্রত্যেকটা সম্পর্ক আসলে শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় এসে শেষ হয়।
জয় গোস্বামী : আসলে শেষ সময়টা এবং এর পরে কি যে আসবে তার পিছনে বিচ্ছেদের একটা অবদান থাকবে। এটা যেন স্থায়ী হয়ে থাকল।
কমল: দুঃখবাদীতার একটা ছাপ হয়ত থাকে কিন্তু শরীরে আনন্দের উত্থান লক্ষ্য করা যায়।
জয় গোস্বামী : এগুলো সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। আমার এরকম একটা কবিতা আছে। কবিতাটার নাম হচ্ছে, এই একটা দুপুর। এটা আপনারা পড়েননি। আপনার একটা ব্যক্তিজীবন আছে। আর আপনি যখন লিখছেন তখন সেখানে জীবনের একটা টান আছে। লেখা পড়ছেন আর সেই টান আসছে। এরপর সেই পর্দা খুলে যায়। ঠিক সেরকম আরেকটা আসে। যদি বলেন তো, সেই কবিতাটা আমি পড়তে পারি। এই কবিতাটি লিখতে গেলে হয়ত আরো দশটি কবিতা লেখা হয়ে যেত। এরপর দেখা গেল অশান্তি লেগে গেল। তাই আর পরে লেখা হয়ে উঠেনি।
এক নজড়ে জয় গোস্বামী দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় কবি। জন্মেছেন ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর কলকাতা শহরে। ছোটবেলায় তাঁর পরিবার রানাঘাটে চলে আসে। ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ (১৯৭৬), ‘প্রত্নজীব’ (১৯৭৮), ‘আলেয়া হ্রদ’ (১৯৮১), ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ (১৯৮৬), ‘ভূতুমভগবান’ (১৯৮৮), ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?’ (১৯৮৯), ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’ (১৯৯৪), ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ (১৯৯৫), ‘ওহ স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’ (১৯৯৪), ‘পাতার পোশাক’ (১৯৯৭), ‘বিষাদ’ (১৯৯৮), ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ (১৯৯৮), ‘মা নিষাদ’ (১৯৯৯), ‘সূর্য পোড়া ছাই’ (১৯৯৯), ‘জগৎবাড়ি’ (২০০০), ‘প্রেতপুরুষ ও অনুপম কথা’ (২০০৪) তাঁর কবিতার বই। গদ্যেও কম যান না কবি। লিখেছেন ‘সেইসব শেয়ালেরা’, ‘মনোরমের উপন্যাস’, ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ’ বা ‘সব অন্ধকার ফুলগাছের’ মতো দুর্দান্ত সব জনপ্রিয় উপন্যাস। গোঁসাইবাগান নামে কবিতাবিষয়ক গদ্য লিখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দুইবার- ১৯৯০ ও ১৯৯৮ সালে। ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।