ফেরা

ফয়সাল কবির
ফয়সাল কবির - ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
6 মিনিটে পড়ুন
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
সাময়িকী.কম
অণুগল্প
912e9e21b80fa773d08d8d7e1f36a64a 1 ফেরা
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
রাতে তুর্না নিশিতায় চট্টগ্রামী আন্তনগর ট্রেনে উঠেছি। বাবা-মা-কে দেখতে মাঝে মাঝেই হোস্টেল ছেড়ে বাড়িতে আসতে হয়। এবারের, ব্যাপারটাও প্রত্যেকবারের মতন সাধারণ ব্যাপার ছিলো।
ট্রেনে উঠে নিজের সিটে বসার সময় আর সব সিঙ্গেলদের মত আমারও মনের আকাঙ্খা ছিলো, আমার পাশের ফাঁকা সিটটায় আমার সমবয়সী কোন ছেলে যেন বসে। মেয়েদের কথা চিন্তা করা আর মাঝরাতে সূর্য উঠার কথা চিন্তা করা একই।
মাথার উপরে বাংকে ব্যাগ রেখে মোবাইল নিয়ে আনমনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম। বাবা-মা’র আদর-যত্ন, দাদুর পান খাওয়া, পুকুরে মাছ ধরা ;আহ ! সব যেন এখন ইতিহাস
একজোড়া ধবধবে সাদা হাত মুখের সামনে আসতেই চমকে উঠলাম। ট্রেনেও কি ভূতের আনাগোনা আছে কিনা!  থাকতেও পারে, ভূত-পেত্নী যে অদৃশ্য। মুখ তুলে উপরের দিকে তাকাতেই আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল, আমি যেন অষ্টম আশ্চর্য দেখছি। কোথাকার এক বিদেশিনী এসে বাংকে ব্যাগটা রেখে ঝপ করে আমার পাশে বসে পড়লো। বাহ!  ভাগ্যদেবী আজ পুরো সহায় আমার উপর।
“হাই, আই অ্যাম ভিক্টোরিয়া পাওলো, নাইস টু মিট ইউ”
‘আই অ্যাম জাহিদুল ইসলাম। হোয়্যার ইউ ফ্রম ?’
“আই অ্যাম ফ্রম অস্ট্রেলিয়া”
এরপর,  ছয়-সাত ঘন্টার জার্নিতে অনেক্ষণ ধরে ব্লগর-ব্লগর করেছি। যতটুকু জানলাম তা শুনে আমি নিজেই আফসোস করলাম। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর বলার প্রয়োজন হয়না। মেয়েটা হালকা হালকা বাংলা ভাষাও জানে। তার অনুভূতিগুলো পরিষ্কার জলের মত, একফোঁটা আবর্জনাও নেই।
মেয়েটা জাতিতে ইরানি, অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠেছে। পরিবার পরিজন সবাই অস্ট্রেলিয়াতে। বাবার নিজস্ব ওয়্যারহাউজ আছে আর ভিক্টোরিয়া একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। বাংলাদেশে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে অদ্ভুত একটা উত্তর জানলাম। ভিক্টোরিয়ার চোখ অশ্রুতে টলমল করছে, নদীতে ভরা জোয়ার আসলে যেমন পানি বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে ঠিক তেমনটাই ভিক্টোরিয়ার চোখের দিকে তাঁকিয়ে সেদিন বুঝেছিলাম।
ভিক্টোরিয়ার বাবার ওয়্যারহাউজে ফিরোজ নামে একজন চাকুরি করতো। খুব হ্যান্ডসাম ও ড্যাসিং টাইপের ছেলে-ভিক্টোরিয়ার ভাষ্যমতে। ভিক্টোরিয়া আর ফিরোজ লিভ-টুগেদার করতো। দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড ভালবাসতো। তাদের ভালোবাসার কথা শুনে সেদিন প্রথম আমার বুকের বামদিকে মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। এরপর, ফিরোজ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসে। প্রথম দুই-আড়াই মাস কথা হতো ভালোই ‘ভাইবার,স্কাইপি, ফেইসবুক’ এর কল্যাণে। ভিক্টোরিয়া বললো, সমস্যা দেখা দিয়েছে গত চারমাস ধরে। ফিরোজকে ফোন দিলে পাওয়া যায়না, সবসময় ওর নাম্বার বন্ধ থাকে। আমার মনে মনে প্রশ্ন জাগলো, এত বড় হাদারাম কি সত্যিই এদেশে আছে। কোটিকোটি টাকার সম্পত্তি, সুন্দরী রমণী, শিক্ষিত আবার কর্মজীবীও বটে।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নেমে পাহাড়তলির দিকে হাঁটতেই সূর্যের তপ্ত আলো চারদিকে ছেয়ে আছে। ভিক্টোরিয়ার সাথে বিদায় নিয়ে স্টেশনের বাইরে চলে আসলাম। হঠাৎ কি মনে করে দৌড়ে স্টেশনের ভিতরে চলে গেলাম। ভিক্টোরিয়া যেখানটায় একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলো এখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ; খুব পর্যুদস্ত লাগছিলো। ভিক্টোরিয়ার চেহেরা শুকিয়ে রয়েছে , বোঝাই যাচ্ছে খুব চিন্তিত। ভিক্টোরিয়াকে সাহায্য করার কথা জানতে ওর চেহারায় আগের মত হয়ে গেল। হাসিখুশি চটপটে মেজাজের মেয়ে। ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে জি.ইস.সি-র মোড় হয়ে ওকে একটা হোস্টেলে ড্রপ করে হোস্টেলে ফিরলাম।
হোস্টেলে ব্যাগ গুছিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কিন্তু, পরক্ষণেই ভিক্টোরিয়ার চেহারাটা ভেসে উঠলো। পরক্ষণেই, ভিক্টোরিয়ার হোটেলের সামনে এসে বসে বসে নিজের একাকীত্ব জীবনের রুবিকস কিউব মিলাচ্ছিলাম। কখন যে দেয়ালের সাথে ঘেঁষে সারারাত কাঁটিয়ে দিয়েছি খবর নেই।
সকালবেলা চোখের সামনে ভিক্টোরিয়ার হাঁসি-হাঁসি মুখ দেখে চমকে উঠি। সকালের নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি ফিরোজের ঠিকানা খুঁজতে। কক্সবাজারের বাসে উঠার সময় ভিক্টোরিয়া একগাঁদা চকলেট, চিপস আর একটা টকটকে লাল গোলাপের বুকে নিয়ে উঠে। বাসের সবাই ভাবছিলো আমাদের মাঝে কতইনা মধুর সম্পর্ক !
অবশেষে ফিরোজের ঠিকানা পাওয়া গেল; কক্সবাজার জেলার পেকুয়া বাজার থেকে এক ক্রোশ দূরে স্টীলের ব্রীজের পর ফিরোজদের বাড়ি। পুরো বাড়ি টাইলস করা, বাড়ির দেওয়ালগুলোতে রাজকীয় নকশা করা। ফিরোজদের বাড়িতে পৌঁছে জানা গেল, বিনপি-জামাত আর আওয়ামীলীগের অবরোধের সময় ফিরোজ দেশে ফিরে আসে। এসময় বাড়ি ফেরার পথে পেকুয়ার আগে ফিরোজদের যাত্রীবাহী বাসে কে বা কারা পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারে। ফিরোজ এ সময় প্রচণ্ড রকমের আহত হয়। থানা
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার পরপরই তার মৃত্যু ঘটে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ভিক্টোরিয়াকে কীভাবে এটা বলব। তার পরও একসময় বলতে হলো। নিজের কানকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না,
“হোয়াট! ফিরোজ ডাইড? ফিরোজ ?”
আমি মুখ ভার করে মাথা নাড়লাম। ভিক্টোরিয়া দুহাতে মুখ ঢাকলো। বাড়ির সবাই যেন পুরোনো ব্যাথা মনে হওয়ায় আরেকদফা কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমরা ফিরোজের কবরের কাছে গেলাম। ভিক্টোরিয়া গোলাপ ফুলের বুকেটা ফিরোজের কবরের ওপর রাখলো। মাটির দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ভিক্টোরিয়ার পুরো শরীর কান্নার শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল । আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। ভিক্টোরিয়া সেদিন ফিরোজের বাবা-মা সবার সাথে কথা বলে ওদের হাতে একটা বড় অঙ্কের অ্যামাউন্ট দিয়ে চলে আসলো। আমি সেদিন বুঝেছিলাম, সত্যিকারের ভালোবাসা কিভাবে মানুষকে কাঁদায়।
ভিক্টোরিয়া পাওলো বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রেখেছিলো কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো ভালবাসার কিছু স্মৃতি। ফিরোজের পুরোনো জামা-কাপড়, ব্যাবহার্য সার্টিফিকেট, এই দেশের আইডিকার্ড এমনি টুকি-টাকি অনেক কিছু।
দীর্ঘ দশমাস পর,
কম্পিউটারে কিছু কোডিং করছিলাম।
“ভি-আই-পি মেইল রিসিভড”- লেখাটা দেখে চমকে উঠি।
ভিক্টোরিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে মেইলে লিখেছে, “হি ইজ ব্যাক”।
আমি পুরোপুরি অবাক হলাম তাই জিজ্ঞাসা করলাম-  ‘হু?’
ফিরোজের রেখে যাওয়া আর আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আজ ফিরোজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই অনেক খুশি হতো! জানো, আমাদের ছেলের নাম রেখেছি,
“জাহিদ”- তোমার নামটা আমাদের তিনজনের মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে। তোমার উপকারের কথা কোনদিন আমি ভুলবোনা।
মেইলের অ্যাটাচমেন্ট করা ফাইল খুলতেই দেখতে পেলাম ফর্সা ফুটফুটে এক নবজাতকের ছবি। আমি কখনো ফিরোজকে দেখিনি। দেখলে হয়তো কমেন্ট করতে পারতাম, ছেলেটা ফিরোজের মতো হয়েছে কি না!

(সমাপ্ত)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
অনুসরণ করুন:
কর্মজীবী এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!