আবু রাশেদ পলাশ
সাময়িকী.কম
চলতি পথে তোরাব আলীর কবরটা চোখে পড়ে সহসায় । কলিমুদ্দির বড়ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের ঘন অরণ্য । তারই কূলঘেঁষে কবরটা । অযত্ন আর অবহেলায় যুগ যুগ ধরে পড়ে থাকে কেবল । ওর চারপাশে কাঁচা বাঁশের বেড়া দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা কেউ । সন্ধ্যার অন্ধকারে হাটুরে দলের একজন হয়ে ফেরার পথে কবরটা দৃষ্টিগোচর হলে বুকটা ধূরু ধূরু করে কেমন । দরগাতলা গ্রামে তোরাব আলীর বাড়ীটা বাজারমুখী কাঁচা রাস্তার কূলঘেঁষে । কালের বিবর্তনে গাঁয়ে বাড়ী বাড়ী টিনের দুচালা ঘর শোভা পায় হরহামেশায়, তোরাব আলীর বাড়ীতে সে দৃশ্য কল্পনাতীত । সময়ের পরিক্রমায় সংসারে লোকসংখ্যা বেড়েছে তার । সেই সাথে বেড়েছে ঘর । ছনের ছাউনি দেওয়া ছোট খুপরি ঘরগুলো এখনো সদা দৃশ্যমান এ পাড়ায় । আমাদের বয়স যখন পাঁচ কি ছয় তখন আমরা দেখেছি বুড়ো তোরাবকে । তামাটে চেহারার বেঁটে বুড়ো । মুখে আধাপাকা দাড়ি আর মাথায় লম্বা চুল ছিল তার । চোখে চিরকালের দীনতা, হাঁসির বড় অভাব ছিল মুখে, কথারও । পরনের লুঙ্গিটা কোমর অবধি গুঁজে পাড়ায় পাড়ায় বাহারি পণ্য ফেরি করে বেড়াতো সে । “ আয়গো মা বুজান হাড়ি নিবানি, সীসার হাড়ি সীসার কলস ”।
শীতে খেজুরের রস ফেরি করতো তোরাব আলী । তখন চোখে ঘুম ছিলনা তার । আমরা দেখেছি, পৌষের শীতে পাড়ায় ঘুরে খেজুরের রস আহরণ করতো সে । তারপর সকাল হলে কলসভর্তি রস নিয়ে গাঁয়ের পথ চষে বেড়াতো বুড়ো মানুষটা । সুযোগ বোঝে গাঁয়ের ছেলেরা জটলা করতো ওকে ঘিরে ।
-আয়গো কাহা, রস দিবানি খামু কই ?
-এক গেলাস আটআনা, আচেনি আলীর পুত ?
-কাল বিয়ানে দিমু নিয্যস আজের টেহা বাহি থও ।
শুরুতে হয়তো আপত্তি করে তোরাব আলী । পৌষের শীতে পাড়া ঘুরে সংগৃহীত রস বাকিতে দিতে ইতস্ততবোধ হয় তার । গাঁয়ের ইঁচড়েপাকা ছেলেগুলো যে হার হারামজাদা এ কথা কে না জানে ? বাকিতে রস দিলে সে টাকা ফেরত পাবার সম্ভাবনা সামান্যই । তবুও ফেরার পথে মনে যেন বাঁধ সাধে তার । তারপর হয়তো ফ্রিতেই দু তিন গেলাস রস ছেলেদের মধ্যে বিলি করে সে । বুড়ো তোরাব ছিল এমনই মানুষ ।
তোরাব আলীর বাড়ীতে আমরা মেয়ে মানুষ দেখিনি কোনদিন । সংসারে কেবল দুটি ছেলে ছিল তার সলিম, কলিম ।আদৌ তার স্ত্রী ছিল কিনা সে খবরও সঠিক করে বলতে পারতোনা কেউ । গাঁয়ের প্রবীণ ওহাব আলীকে প্রশ্ন করলে কতক্ষণ মাথা চুলকাতো সে । তারপর বলতো-
-হাচানি কওন যায়, বউ ঝি কোনদিন দেহিনায়গো বাপ ।
মরার আগে কষ্ট করেছে তোরাব আলী । গায়ে কি এক পচন রোগ হয়েছিল তার । দেহের মাংস খসে পরেছিল শেষ কালে । হালগাঁও হতে দাওয়া দিতে এসে চমকে উঠেছিল বিনুমোল্লা । বলেছিল-
-সব্বনাশ । শত্তুর আছেনি তোরাব কওতো, বিষবান দিছে মালুম অয় ?
তোরাব আলী মারা যাওয়ার পর ডাঙায় তোলা চিতল মাছের মত আহাজারি করেছিল ছেলেরা । কলিম তখন নওজোয়ান, মুখে কাঁচা দাড়ি উঠেছে তার । সলিম আরও ছোট । বাপের কথা মনে হলে কবরের পাশে বসে আর্তনাদ করতো দুজন । প্রতিবেশী মহেদ আলী সান্ত্বনা দিত কলিমকে ।
-দিলরে সবুর দে কলিম । ভাইরে পাইল্যা ডাঙ্গর কর ।
তারপর সংসার রক্ষার্থে কলিমুদ্দিন বাপের ফেরিওয়ালা ব্যবসার উত্তরসূরি হয় । ধীরে ধীরে সংসারে খানিক সচ্ছলতা আসে তার । ঘরে বউ আসে একদিন । নবজাতকের কান্নার শব্দে গম গম করে বাড়ীটা । খুশিতে পালের বলদ জবেহ করে পাড়ায় ভোগ দেয় সে । বছর না ঘুরতে সংসারি হয় সলিমও । সোনাতলা গ্রামের রূপসী কন্যাকে ভাইয়ের বউ করে আনে কলিমুদ্দিন ।
কলিম আর সলিমের সংসারটা হয়তো সুখকর হতে পারতো । কিন্তু হয়নি । একই সংসারে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিল ষোল আনা সাথে বউয়ে বউয়ে মিলের অভাবও ছিল খুব । সংসারে নানা ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও কলহ হত দুজনের । এরপর একদিন সন্ধ্যায় কলিমুদ্দিন সওদা করে বাড়ী ফিরলে একই সংসারে ঘোর আপত্তি তুলে মনয়ারা ।
-একখান কতা কমু আপনেরে, দিলে ডর পাই ।
-ডর কিয়ের ? আমিনি শত্তুর অই ?
-সলিমরে জুদা দেন । একলগে থাকুন দায় ।
বউয়ের কথায় রাজি হয়না কলিমুদ্দিন । মনে কোথাও বাঁধ সাধে তার । তারপর মনয়ারাকে শাসায় সে-
-বিষদাঁত ভাঙ্গুম মাগীর । অমুন কতা কবার নয় ।
কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়না এতে । ভাইদের দৃষ্টির অগোচরে বউদের তীক্ষ্ণ বাক্য বিনিময় আহত করে নিজেদের । সংসারের কঠিন আবর্তে পরে আহত হয় সলিম কলিম স্বয়ং । তারপর হয়তো বউদের বিষবাক্যেই চোখের দূরত্ব হয় দুজনে । এরপর একদিন স্বামীর কাছে সংসার আলাদা করার ইচ্ছে প্রকাশ করে হালিমা ।
-বাপের বাড়ী ছাড়ান দেও হামাক । মাগীর লগে থাকুম না কই ।
অবশেষে সংসারে সুখের কথা ভেবেই হয়তো আলাদা থাকার চিন্তা করে সলিম । কলিমুদ্দিন আপত্তি করেনা তাতে । তারপর সংসারে বিভাজন হয় দ্রুতই । একই বাড়ীতে মাঝ বরাবর বাঁশের দেউরী উঠে একদিন । যৎসামান্য আবাদি জমিটুকুও ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় দুজনে । তারপর সংসারে বউদের কুটজালে আবদ্ধ হলে ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয় দিনে দিনে । সে দূরত্ব গগনবিদারী, তীব্র থেকে তীব্রতর । দিনে দিনে সংসারে লোকসংখ্যা বাড়ে । দুভাইয়ের বাড়ীতে একটা একটা করে ছনের দুচালা ঘর উঠে অসংখ্য ।
গেলবছর চৈত্রে অসুখে পরেছে কলিমুদ্দিন । সারেনি এখনও । আজকাল থেমে থেমে গায়ে জ্বর আসে তার । শেষ রাতে শরীরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে । হাকিম দশানী বাজার থেকে দাওয়া এনে দেয় বাপকে । এ পাড়ার মুগা ডাক্তার বাড়ী ফেরার পথে দেখে যায় কলিমকে । হাকিম বলে-
-শরীরখান কাতরগো ভাই । ভালা দাওয়া দেও একখান । মুগা বলে-
-বাপরে গঞ্জে নেও শিগগির । সুরত কই ভালা দেহিন্যা আইজ ।
বুড়ো বয়সে কলিমুদ্দির অসুস্থতা বিচলিত করে মনয়ারাকেও । স্বামীর এহেন দুর্দশায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় সে । উপায়ান্তর না দেখে পালের বড় বলদটা বাজারে বেচে দেয় হাকিম । সিদ্ধান্ত হয় শীঘ্রই বাপকে গঞ্জে নিবে সে ।
এরমধ্যে একদিন দরগাতলার কালুগাজীর সাথে কলহ হয় সলিমের । কলিমুদ্দির তোলনায় সংসারে অসচ্ছল সে । সংসার রক্ষার্থে বছর দুই আগে বাড়ীর পাশের আবাদি জমিটা মণ্ডলের কাছে বন্ধক রেখেছিল সলিম । শোধ সমেত টাকা ফেরত দিতে পারেনি আজও । সম্ভাবনাও নেই ভেবে কালুগাজী আরও কিছু টাকা নেওয়ার বিনিময়ে জমিটা লিখে দিতে বলে তাকে । সলিম আপত্তি করলে কলহ করে দুজন । তারপর ফেরার পথে শাসায় কালুগাজী ।
-হালার পুত, দিন গুনন্যা কইয়ে থুই জমির শোধ জানে নিমু ।
কালুগাজী শাসালে মনে মনে বিচলিত হয় সলিম । ঋণের টাকা শীঘ্রই শোধ না হলে এই সামান্য জমিটুকুও হারাতে হবে তাকে । গাজী কি আর যে সে লোক । এ পাড়ার মোড়ল সে । পাড়ায় সবাই সমীহ করে তাকে । উত্তরপাড়ার আরজু ঘটক সলিমের বন্ধু মানুষ । সে বলে-
-তোমার ভাই বলদ বেচছে জাননি সলিম ? হাঁচা কতা হগল কও । দিলে গোস্যা যায় থুক তোমারেনি ফেলবো হে ?
আরজুর কথা মনে ধরে সলিমের । এ গাঁয়ে আপন বলতে কলিমুদ্দিন ছাড়া কেউ নেই তার । মনে অভিমান যায় থাকুক ভাইয়ের দুর্দশা হয়তো বোঝবে সে । এরপর একদিন কলিমুদ্দির বাড়ীতে দেখা যায় সলিমকে । সে বলে-
-শইলে ব্যারাম হুনি । দাওয়া নেওনি মিয়া ভাই ? কলিম বলে-
-হ, মরার ব্যারাম ছাড়েনি ? কিছু কবি মালুম অয় ?
-হাতত টেহার অভাব । গাজীর বেটায় তাগিদ দেয় ধারনি দিবা কিছু ?
কলিমুদ্দির ইচ্ছায় বাঁধ সাধে বউ ছেলে । হাকিম বলে-
-টেহানি কাহা ? বাজানরে গঞ্জে নিমু শিগগির ।
অবশেষে আশাহত হয়ে ফিরে আসে সলিম । আসার সময় কলিমুদ্দির সাথে কলহ করে সে ।
-ভাইনি, শত্তুর মালুম অয় শত্তুর । আল্লার তন গোস্যা থুই । উচিত শাস্তি দিব হে ।
সলিম কিছু বললে প্রতিবাদ করেনা কলিমুদ্দিন । চোখদুটো কেবল ছলছল করে তার । এরপর একদিন সকালে কলিমুদ্দির বাড়ীতে মেয়েমানুষের আর্তনাদ শুনা যায় । গত রাতে কে বা কারা সিঁদ খুঁড়েছে কলিমের ঘরে । সবকিছু ঠিকঠাক কেবল কাঠের বাক্সে রাখা নগদ টাকা গুলো চুরি গেছে তার । সেই শোকে আর্তনাদ করে মনয়ারা । কলিমুদ্দির অসুস্থতা বাড়ে দিনে দিনে । বাপকে গঞ্জে নেওয়ার সামর্থ্য হয়না হাকিমের । সলিমের বউ হালিমা বড় ঘরের দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলায় দিনমান । গাঁয়ের মেয়েরা পান খাওয়ার বাহানায় সমবেত হলে বুনো হাঁসি হাঁসে সে ।
-উচিত বিচার অইচেগো বু । আল্লানি বেঈমান কওতো ?
সলিমের ঋণ শোধ হলে খোশ মেজাজে থাকে সে । সেদিন কলিমুদ্দির কাছ থেকে আশাহত হয়ে ফেরার পর আরজু টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তাকে । আজকাল প্রায়ই দশানী বাজার থেকে ফেরার পথে সলিমের বাড়ী হয়ে যায় আরজু । ও এলে দাওয়ায় বসে খোশগল্প করে সলিম ।
আষাঢ় মাসে বর্ষার ঢল নামে দরগাতলায় । বৃষ্টির অবিশ্রাম ধারা গৃহবন্দী করে গাঁয়ের দরিদ্র মানুষ গুলোকে । উত্তর হতে পাহাড়ি ঢল নামলে বন্যায় প্লাবিত গেরস্থ বাড়ী গুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মত মনে হয় । নন্দকুসা নদীতে জোয়ার আসে এ সময় । পৌষ-মাঘ মাসে যে নদী শুকিয়ে মরা গাঙের রূপ নেয় আষাঢ় মাসে সে পূর্ণ যৌবনা । ওর বুকে তখন সওদাগরী নৌকা শোভা পায় । ঢেউয়ে নদীর তীর ভাঙে । আবাদি জমি হারায় চাষিরা । কলিমুদ্দির নদীপাড়ের আবাদি জমিটা ভাঙনের মুখে পরলে চিন্তিত হয় সে । এহেন দুর্গতিতে ভাইপোরা রীতিমত তাণ্ডব নৃত্য করে তাকে নিয়ে । কলিমুদ্দির ছেলেরাও কলহ করে তাতে ।
আউসের মৌসুমে ক্ষেতে হাল দেওয়ার বলদ থাকেনা কলিমুদ্দির । মাঝিপাড়ার জয়নাল তার হালের গরুটা দিতে চেয়েছিল তাকে । গতকাল এসে না করে গেছে সে । সলিমের হাল নিয়ে ভাবনা নেই । গোয়ালে জোড়া বলদ আছে তার । ওর ছেলে নালু মজুরীতে জমি চষে দেয় । আউসের মৌসুমে নগদ টাকার মালিক হয় । উপায়ান্তর না দেখে সলিমের বলদটা একদিন চাইতে যেতে হয় কলিমুদ্দিন কে । রাজি হয়না সলিম । সুযোগ বোঝে দু চার কথা শুনিয়ে দেয় উল্টো ।
-বলদনি ? হাল দিমু নবার ক্ষেত । হামাক ক্ষেমা দেও ।
আশাহত হয়ে ফেরার পথে বড় রাস্তার মোড়ে প্রকাণ্ড বটগাছটার নীচে বসে বিশ্রাম নেয় কলিমুদ্দিন । হিন্দুপাড়ার বিনুবংশী গরু ঘাস খাওয়াতে গেলে চোখাচোখি হয় দুজনের । বিনু বলে-
-বলদ পায়লানি কলিম ভাই ?
-নাগো ভাই । নিমুকহারামি ।
-ছাড়ান দেও । আমার বলদ নিও কাইল ।
অবশেষে বিনুর বলদে হালের ব্যবস্থা হয় কলিমুদ্দির । বিনিময়ে মোটা টাকা গুনতে হয় তাকে । এর দিন দশেক পর আবার কলহ হয় সলিম কলিমের মধ্যে । সেদিন সলিমের পালের বাছুরটা ঘাস খেতে কলিমের খেতে গেছিল । হাকিমের দৃষ্টিগোচর হলে ধরে এনে দিনভর গোয়ালে বেঁধে রেখেছিল সে । সন্ধ্যায় নালু সারা গ্রাম বাছুর খুঁজে হয়রান হয়েছে । ফেরার পথে নকু জানায়-
-তগো বাছুর হাকিম নিছে মালুম অয় । খোঁজ নে শিগগির ।
তারপর বাছুর আনতে যেয়ে হাকিমের সাথে কলহ করেছে নালু । ক্ষিপ্ত হাকিম জোরে ঘুষি দিলে নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছে তার । অবশেষে ফেরার পথে চিৎকার করেছে নালু ।
-হালারপুত, হামাকনি মারলি আইজ । জান নিমু ডরাইস ।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন কলহ হয় ভাইয়ে ভাইয়ে । ওরা কলহ করলে গাঁয়ের ছেলেরা থামানোর চেষ্টা করে দুজনকেই । ষাটোর্ধ্ব করিম গাজী ধমকায়-
-ইতা কেমুন কাম অইলো, ভাইয়ে ভাইয়ে কলহ ভালানি ? এরপর ভরা মজলিসে একদিন অভিযোগ করে সলিম ।
-বাপের ভিটায় ঠহায়চে হামাক । জমি হগল মাপুম কই ।
ওর কথা শুনে চিৎকার করে কলিমুদ্দিন- নিমুকহারাম, বাপের ভিটায় শিকলনি । জান দিমু জমি দিমুনা নিয্যস ।
কালুগাজীর উপস্থিতিতেও সেদিন কলহের মীমাংসা হয়না দুপক্ষে । অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সবাই । এর কদিন পর কলিমুদ্দির পালের বলদটাকে কোপিয়ে আহত করে সলিমের ছেলেরা । সেদিন দড়ি ছিঁড়ে সলিমের খরের গাদায় মুখ দিয়েছিল সে । এই অজুহাতে নালু হাতের কাস্তে দিয়ে কয়েকটা কোপ দিয়েছে শরীরে । চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়েছে বলদটার । সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি পাষণ্ডটা । বলদের গায়ে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে শিউরে উঠে কলিমুদ্দিন । তবে অন্যান্য দিনের মত উপযাচক হয়ে কলহ করেনা সে । হাকিম কিছু বলতে গেলে বাঁধা দেয় বরং ।
-গোস্যা ক্ষেমা দে হারামিরপুত গাওনি তর একলা জ্বলে ?
কলিমুদ্দির এমন কথায় খুশি হতে পারেনা হাকিম । মনে মনে হয়তো রাগটা পোষে রাখে সে ।
এরপর আশ্বিন মাসের এক সন্ধ্যার ঘটনা । একদিন বাজার থেকে সওদা করে বাড়ী ফিরছিল সলিম । কলিমুদ্দির বাড়ীটা পেরিয়ে আসার সময় হাকিম আর নবার দ্বারা বাঁধাগ্রস্ত হয় সে । “ হারামিরপুত ”-বলে ধমক দিলে এক কথায় দুই কথায় ক্ষিপ্ত হারু নিজের কাছে থাকা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে মাথায় । পরমুহূর্তে “আল্লাগো” বলে মাটিতে লুটিয়ে পরে সলিম । ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয় হাকিম । এরপর চোখের পলকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় দুজনই ।
ছেলেদের এমন কর্মে হতভম্ব হয় কলিমুদ্দিন স্বয়ং । গাঁয়ের বড়োরা তিরস্কার করে তাকে । করিম গাজী বলে-
-ইতানি কাম অইলো কলিম, পুলা দিয়্যা ভাইরে মারলা ?
করিম গাজীর কথার সহসা জবাব দেয়না কলিমুদ্দিন । মনে মনে হয়তো সেও আর্তনাদ করে ভাইয়ের জন্য । এ খবর জানার কথা নয় গাঁয়ের কারও । সম্মুখে যা দৃশ্যমান তাই সত্যি সবার কাছে । মনের খোঁজ রাখে কে ? তারপর গ্রামবাসীর সহায়তায় আলীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় সলিমকে । পরদিন গাঁয়ের ছেলেদের প্ররোচনায় আলীপুর থানায় মামলা ঠুকে দেয় নালু মিয়া । চৌকিদার কেদারনাথ কলিমুদ্দির বাড়ীতে ছেলেদের খোঁজ করে । ব্যর্থ হলে কলিমকে বেঁধে নিতে চায় সে । কালুগাজী বাঁধা দিলে সেদিনের মত ফেরত যায় কেদারনাথ । তারপর সহসা কলহের মীমাংসা হয়না সালিশ করেও । গাঁয়ের মুরব্বীরা কলিমের হয়ে কথা বলতে গেলে অপদস্ত হয় নালুর কাছে ।
একদিন সকালে আরজুর বাড়ীর দহলিজে পুরুষের কণ্ঠ শুনা যায় । বাইরে বেরিয়ে এসে কলেমুদ্দিনকে দেখে আশ্চর্য হয় আরজু । সে বলে-
-কলিম ভাইনি ? আহ অন্দরে আইয়ে বহ ।
আরজুর ঘরের বারান্দায় বসতে দেওয়া হয় কলিমকে । আরজু আবার বলে-
-একখান কতা ভাই । গোস্যা ছাড়ান দেও । নিজের ঘরে সিঁদ দিছ হগগল জানি মুই । সলিমরে অত টেহা আমার দিওনের সাধ্যি আচিলনি ?
-পুরান কতা ছাড়ান দে ঘটক । এ গোস্যা ছাড়ুনের না ।
-হগগল কইলে সলিম বুঝবো নিয্যস ।
কিন্তু তাতেও রাজি হয়না কলিমুদ্দিন । ভেতরে অদ্ভুত এক অভিমান পোষে রাখে সে । রাতে প্রায়ই পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে । ভাইয়ের জন্য মন পুড়ে তার । জানো ভালবাসার জন্য যে হৃদয়, ভালবাসাহীনতায় দগ্ধ হয় সেই । এরইমধ্যে একদিন আলীপুর থানা থেকে পুলিশ এসে জবানবন্দি নিয়ে যায় সলিমের । মনের মধ্যে থাকা অভিমানগুলো অকপটে স্বীকার করে সে । তারপর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আলীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন অপরিচিত মানুষের আনাগোনা দেখা যায় । কাঁধের গামছা দিয়ে মুখটা ডেকে রাখে সে । নালুর সামনে পরলে ঘুরে দাঁড়ায় । এরপর সুযোগ বুঝে লোকচক্ষুর অন্তরালে সলিমের ঘরে ডুকে সে । সলিম বলে-
-কেডাগো হারুনি ?
সলিমের কথার সহসা জবাব দেয়না কলিমুদ্দিন । মুখের গামছাটা সরিয়ে নিলে হতভম্ব হয় সলিম । সে বলে-
-মিয়া ভাই……….
-হ ।
-হাতত কিছু মালুম অয় ।
-পান্তা, লগে বিমুট্টে কলা । ন্যাংটাকালান খাইতি কত ।
হঠাৎ চোখাচোখি হলে দৃষ্টিগোচর হয় সত্যিটা । দুজনেরই চোখে জল এসেছে কখন যেন অথচ লোকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা । সলিম বলে-
–আহ ভাই মিলল্যা খাই ।
–
লেখক:
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,সাভার, ঢাকা।
লোকসাহিত্য ও জসীমউদ্দীন গবেষক।