সাময়িকী.কম
কবিদের কাজই হল শব্দ নিয়ে খেলা করা। এজন্যই হয়ত মাইকেল মধুসূধন দত্ত বলেছিলেন, শব্দে শব্দে বিয়ে দেয়াই হচ্ছে কবিতা। কবিতা কোন কার্বণ কাগজের কালি নয়। কবিতা কাল থেকে কালান্তরের এক নির্জলা ছবি। সময়ের পৃষ্ঠে যা আল্পনা এঁকে যায় অবলীলাক্রমে। জীবনের নিবিষ্ট চিত্তের বেদীতে দাঁড়িয়ে কবি শিল্পের আরাধনায় মত্ত থাকেন। শব্দ শিল্পই তখন হয়ে ওঠে কবির নিজস্ব আলয়। তাইতো কবিতায় কবি এঁকে যান, রেখে যান মানুষের আসল সত্য। কবিতা কোন ভূঁইফোঁড় শিল্প নয়। তার বিকাশের পশ্চাতে নিহিত থাকে পারিপার্শ্ব সংলগ্নতার গভীর এক পরোক্ষ ও নিঃশব্দ ইতিহাস। মহাকালের দিনপঞ্জিকাতে যা অম্লান হয়ে থাকে। সূক্ষ্ম চেতনাবাহী অনুসন্ধিৎসু মন সেই অন্তরালাবর্তী সত্যকে সনাক্ত করেই শব্দের মালা গেঁথে সৌধ নির্মাণ করেন অবলীলায়। কবি জফির সেতুর কবিতায় সে শব্দের নিপুন ব্যবহারের পাশাপাশি বিশ্বমণ্ডলের পরিচিত অপরিচিত উপকরণেরও সার্থক প্রয়োগ রয়েছে। পরিচিত উপকরণকে হৃদয়ে ধরে রাখার জন্য আর অপরিচিত উপকরণকে শিল্পের ছোঁয়ায় পাঠক মহলে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য তার প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
কবিতা মূলতই স্বতঃস্ফূর্ত এবং কবির অস্তিত্বের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে। অন্যভাবে বলা যায়, কবিতা কবির উপলব্ধি এবং এ কান্ত সুন্দর অথবা আত্মরতিকে প্রকাশ করে। প্রতিক্রিয়া কিংবা দায় থেকে আর যা–ই সৃষ্টি হোক শিল্প হয় না। কাব্য ইতিহাসের যে যুগ বিভাজন সেই সাহিত্য কর্ম আজ আধুনিক চেতনার ঐশ্বর্য নিয়ে শিল্পের রূপ পরিগ্রহ করেছে। মনে রাখতে হবে শিল্পির নিঁখুত ছোঁয়াতেই কেবল শিল্প সৃষ্টি সম্ভব। কালের মাত্রায় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সংযোগ সূত্রও দৃঢ় হয়ে ওঠেছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাত্রার আঙ্গিকে ব্যক্তি অনুভূতির জটিল ও দুর্বোধ্য প্রবণতাকে ভাষার মানচিত্রে শব্দের গাঁথুনিতে অঙ্কিত করা হয়েছে। আর এই অঙ্কনের মধ্যেই শিল্পীর নিজস্বতা লুকিয়ে থাকে।
আধুনিকতার উৎকর্ষ বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই কলামিস্ট হাসান আহমেদ চিশতী চমৎকার একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “শতাব্দির শিখরে সময় ও কালের চক্রে বলয়ের পর বলয় ছিন্ন করে কবিতার অন্তর্গত তাগিদ, সীমাবদ্ধতা বিদীর্ণ করে বিপুলায়তন বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল অনুভূতিতে চরম সময়ের পরম প্রভাবের ব্যঞ্জন নিয়ে আধুনিক হয়ে ওঠেছে”। অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে, সেখানে আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য দাঁড়ায় পাশ্চাত্যের আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণের পথ পরিক্রমার মায়া জালে। যার বিস্তার মাকড়শার জালের মতই। ফলে আমাদের সমাজ ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে এর প্রভাব একেবারেই ভিন্ন। মননশীলতার পশ্চাদপদতার কারণে অনেক ক্ষেত্রই পিছিয়ে পড়তে হয়। সময়ের সাথে যেমন তখন তাল মিলানো সম্ভব হয়ে ওঠে না, তেমনি শিল্পের প্রকৃত রসদও আস্বাদন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিরাই কবিতা পড়ছে, সাধারণ মানুষের কাছে যেন পৌঁছতেই পারছে না। দেশ কালের ঐতিহ্যে এ বন্ধ্যাত্বের দায়ভার রীতিমতো ভ্রান্তিবিলাসে পরিণত হয়েছে। এ দিক থেকে জফির সেতুর কবিতা একেবারে সাধারণ পাঠকের বোধের সীমানায় বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
কবিতা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প। আর শিল্প কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। যদিও ক্ষেত্র বিশেষ শিল্পীর দায়বদ্ধতা থাকে। অর্থাৎ কবিতা দায়বদ্ধ হতে না পারে কবিতার স্রষ্টা যিনি তিনি অবশ্যই অবশ্যই কোন না কোন ভাবে দায়বদ্ধ ! কবি জফির সেতু যদিও কোন প্রকার দায়বোধ থেকে কবিতা লিখেন নি, নিছক শিল্পের বাগান সৃষ্টিই তার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল তবুও তার কবিতা যেন দায়বদ্ধতারই স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ।
সোনার তরী কবিতা সম্পর্কে রবি ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলে, সেখানে বর্ষার চিত্র ছাড়া কিছুই বিস্তার করেননি। অথচ সাহিত্যের অধ্যাপকেরা এই কবিতা নিয়ে ইহকাল আর পরকাল একাকার করেছেন। কবিতা বিশ্লেষণ পাঠক মাত্রেই ভিন্ন ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে ছাপিয়েই গেলেই তা দৃষ্টিকটু বলে গণ্য হবে। এ চরম বাস্তবতার নিরিখে কবির উপলব্ধিতে সত্যের অকপট প্রকাশ আজ এই উত্তরাধুনিকতাকে ঐতিহ্যের নবরূপে বিকশিত করেছে। সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাষ্ট্রীয় অস্বাভাবিক উন্মাদনায় অনিবার্য প্রভাব মারাত্মক বিস্তার লাভ করে কবিদের মন ও মননে। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, কবিতার আধুনিকতায় আমরা যে কোন প্রভাবের কথাই বলি না কেন তা যতটুকু সত্য নয় তার চেয়ে বড় সত্য হলো যে কোন পরিবর্তনেরই গোড়াপত্তন হয় কালপ্রবাহের মাত্রার অনুশীলনে। তাই সমকালীন জীবন ব্যবস্থাই কবিচিত্তের কাল পরিণতিতেই কবিতার শিল্পরূপ গড়ে তোলে।
ডেড পোয়েটস সোসাইটি মুভিতে রবিন উইলিয়ামস বলেছিলেন – “Medical, Engineering, Business, Law…These are noble professions without which life would be impossible. But poetry, music, romancs….these are the things that make our life meaningful.With the previous professions we become able to live but with the later ones…that’s what we live for!”
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে সাহিত্যের আবেদন অস্তিত্বের দ্যোতকেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে আমাদের সব সময়ই মনে রাখা উচিত দুর্বোধ্য মানেই অর্থহীন নয়। দুর্বোধ্য মনে হলে পাঠকের দায়– তার বোধের অভাব। অথবা পঠন–পাঠনের সীমাবদ্ধতা বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু অর্থহীন হলে? দুর্বোধ্য হয়ে কবিতা চলুক, তা বোধগম্য হবে। তবে অর্থহীন হলে কখনই হবে না। অর্থহীনকে উত্তরাধুনিকতা বলে চালিয়ে নেওয়া কপটতাই মাত্র। উত্তরাধুনিক অনেক কবিদের কবিতাতে এমন চিত্র একেবারেই অমূলক নয়। আসলে লিখলেই লেখা হয় কিন্তু সাহিত্য হতে হলে তাতে দিতে হয় শিল্পের ছোঁয়। কবি জফির সেতুর কবিতা এ দুটো দিক দিয়েই সফল। দুর্বোধ্যতার জটিলতা থেকে তিনি কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন। শুধু তাই–ই নয়, কবিতাকে নিয়ে এসেছেন একেবারে সাধারণ পাঠকের নাগালের মধ্যে। অর্থের মূল্য বিচারেও কোনভাবেই তার কবিতাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যাবে না।
কবিতায় কবিমানস বুঝাই মুখ্য বিষয়। কবিমানস ডুবে থাকে শব্দের গহীন থেকে গহীনে। ব্যক্তিকে সমষ্টিতে যুক্ত করার সংগ্রামে আবর্তিত হয় চিন্তা ও চর্চা। কবি মুক্তচিন্তার শৈল্পিক উপস্থাপনের আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হন অহর্নিশ। যাপনের গ্লানিতে সমৃদ্ধ হয় পাল্টে দেয়ার শব্দচাষ। অনুসন্ধান করতে চান সময়হীনতার মাঝে ডুবে যাওয়া এ মৃত্তিকার সম্ভ্রান্তির ইতিহাস। নিজের সময়কে নিয়ে যেত চান বাকি সময়ের কাছে, বুঝতে চান গতির মন্ত্র। কবি জফির সেতুর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে যেন সে নির্দেশনারই স্পষ্ট রূপ দেখতে পাই।
ছবি যেমন মনের কথা বলে তেমনি কবিতাও অবলীলায় মনের কথা বলতে পারে। শব্দ শিল্পের সূক্ষ্মতাতি সূক্ষ্ম প্রয়োগের মাধ্যমেই সে শিল্পকে সার্বজনীন করে তুলতে হয়। আর এ ক্ষেত্র কবি জফির সেতুর কবিতার জুড়ি নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অসচেতন পাঠক ও বিভ্রান্ত সমালোচকরা বলেন, এ কালের কবিবর্গ উত্তর আধুনিকতার নামে শব্দের খেলা ঠিকই খেলেন, কিন্তু কোন অর্থের হয় না। এমন অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। যাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য আমি মনে করি তাদের শিল্পের বুননে ও মানসিক চাষাবাদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ক্ষেত্র কবি বুদ্ধদেব বসু’র একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে– “কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, বোঝানো ‘ যাবে না”। আর এই বোধটা পরিষ্কার থাকলে উত্তরাধুনিক কবিতার পঠন–পাঠনে খুব একটা সমস্যা হবে বলে আমি মনে করি না।
সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যকে কোন কিছু দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না, তাহলে সৃষ্টিশীলতা থেমে যাবে। আমরা জানি ত্রিশের পরে আল মাহমুদ, গুন, হেলাল হাফিজ, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান এরা কবিতা লিখে গেছেন। তারা যেমন ত্রিশের বলয় ভেঙ্গেছেন তেমনি তাদের পরবর্তী কবিরা তাদের সৃষ্ট বলয় ভেঙ্গেছেন এবং সামনে যারা লিখবেন তারা ও এনাদের স্টাইল ভাঙ্গবেন। কবিতা কোন আয়না না যে যেমন খুশি তেমন করে ভাঙ্গবে ! ভাঙ্গার মাঝেও যে এক ধরনের সৌন্দর্য থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্যের নিয়ম জেনেই তা ভেঙ্গেছেন এবং পরবর্তিতে নতুন নিয়মের সৃষ্টি করছেন। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে উচিত, যারা ভাঙ্গতে জানেন, তারা গড়তেও জানেন। উত্তরাধুনিক কবিরা আধুনিক কবিতার প্লট, ভাব, ভাষা, ছন্দ, উপকরণ, নন্দন শিল্প, উপমার প্রয়োগের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সত্যিকার অর্থেই একটি সৃষ্টি হয় আরেকটি ধ্বংশ করে। উত্তরাধুনিক যুগে কবি জফির সেতুর সৃষ্টিশীলতা কেবলি নতুনত্বতার হাতছানি দেয়। পাঠক তাঁর কাব্য পাঠমাত্রই সে বিষয়টির অনুধাবন করতে পারবে।
কবিতায় মেসেজ দর্শন, বিপ্লব অবশ্যই থাকবে তবে কবিতাগুলো যেন সেটার ভারে নূজ্য না হয়। এটা স্পষ্ট যে, কবিতা লিখার আগে মনের টেবিলে মুখ্য ভাবে কিছু মেসেজ রাখলে, কিছু দর্শন রাখলে কবিতা না লিখে প্রবন্ধ, গল্প লিখাই উচিত। কেবল মেসেজকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখলে সেটা কবিতার বইয়ের চেয়ে লুৎফর রহমানের ” নীতিময় জীবনের জন্য” লিখা প্রবন্ধ মনে হয়। উত্তরাধুনিক
কবিতাগুলো ঐ জায়গাতে তাদের নিজস্বতা বজায় রেখেছে।
কবিতা হলো কবির সৃষ্টি করে দেয়া জগৎ। যেখানে যে কোন পাঠক অনায়াসে বিচরণ করবে। বিচরণ করা আর প্রস্তুকৃত রস আস্বাদন করা ছাড়া পাঠকের আর কোন কাজ নেই। যেমন আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে—শোনার সাথে সাথই আমরা নদীর বাঁকে চলে যাই এবং কবিকৃত দৃশ্যে ঘুরাঘুরি করি নিজে কিছুই বানাই না। অন্যেরটাতে যাই, অন্যেরটা পরি। কবিতা ল একটা অন্তহীন অভাবনীয় জগতের দরজা। যেটা কবি তৈরী করেন তারপর তিনি মৃত। পাঠক সেই দরজা দিয়ে ঢুকে নিজের মতো করে জগতটাকে তৈরী করেন এবংবিচরণ করেন। মনে করেন কবিতা একটি আর দরজা ও একটি কিন্তু পাঠক অনেক। যারা পুরানো নিয়ম–নীতির অনুসারী তাদের মতে পাঠকের মেধা ও মননকে নাড়া দিতে পারে এমন ছন্দোবদ্ধ ও বুদ্ধিজাত উচ্চারণই কবিতা অভিধা পাওয়ার যোগ্য। অপর দিকে উত্তরাধুনিকদের মতে, প্রতিটি মার্জিত উচ্চারণই কবিতা। কবি একটি বিশেষ ভাষা ও কাঠামো ব্যবহার করে তার মনের সাথে কথা বলেন। এ কথাগুলো তার একান্তই নিজস্ব। নিজের মনের সাথে সকল মানুষই কথা বলেন। কিন্তু এগুলো কবিতার আকার ধারন করেনা। কবির ব্যক্তিগত কথা ভাষার জামা পরিধান করে কবিতায় রূপান্তরিত হয়। এখানে পার্থক্যটা কোথায়? পার্থক্যটা হচ্ছে ভাষা এবং বাকবিন্যাসের। সাধারণ কথা এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হলে আমাদের কান এবং মনকে জাগ্রত করতে হয়। কান এবং মনই কবিতার আসল বিচারক।
এটা স্পষ্ট যে, কলম দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন কাগজে আঁকাবাঁকা টান দিলেই যেমন তা চিত্রকর্ম হয়ে যায় না তেমনি যেমন খুশি কবিতায় শব্দ বসালেই তা কবিতা হয়ে যায় না। কবিতার পাঠে অন্তর্গত উপলিব্ধর বিষয়টা বোধহয় একটু বেশি জরুরি। আর এজন্য দরকার সচেতন একাগ্রতা। একসময় জীবনানন্দ দাশ কে দূর্বোধ্য কবি মনে করা হতো। অন্তত তাঁর সময়ে তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এর একমাত্র কারণ জীবনানন্দকে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। তদ্রুপ বর্তমানে যারা আন্তরিকভাবে সৎভাবে দায়িত্ব নিয়ে চর্চা করছেন তার সব হয়তো আমরা বুঝবো না। তাই বলে বিদ্রুপ করাটা সমর্থনযোগ্য নয়। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যারা উত্তরাধুনিক কবিতার চর্চা করছে তাদেরকেও পাঠকের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। তাদেরকে বুঝতে হবে তারা কোন শ্রেণির পাঠকের কাছে কোন ধরনের লেখা উপস্থাপন করবে। তবে অবশ্যই উত্তরাধুনিকতাকে এলার্জিটিক মনে করা যাবে না। চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আলো আসবেই। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজকের যুগ জটিলতায় ও নতুন ধারার প্রতিষ্ঠায় জফির সেতুর কবিতা ফলোআপ হতে যদিও একটু বেশি সময় লাগছে তবুও এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন তাঁর কবিতাকেই মডেল হিসেবে দাঁড় করানো হবে।
‘পোস্টমডার্নিজম’, এর প্রবক্তারা বলছেন, “মডার্নিটি জিনিসটা একসময় জন্ম নিয়েছিল। এখন তার মৃত্যু হয়েছে।’ তারপরে আমরা আরেকটা মতবাদের জন্ম দিচ্ছি। এখন লক্ষ্য করেন এখানে একটা প্রভাবশালী শব্দ আছে ‘টাইম’। তাকে একটা অর্গানিজমের মত দেখতেছি। Mordamity is like a body অর্থাৎ যার জন্ম আছে, বিকাশ আছে এবং মৃত্যু আছে। কিন্তু মডার্নিটির আরেকটা ধারণাও আছে। এটার প্রবক্তা ‘বোদলেয়ার’। শার্ল বোদলেয়ার। ফরাসি কবি, যাঁর কবিতা আমরা অনেকেই ‘বুদ্ধদেব বসু’র বাংলা অনুবাদে পড়েছি। উনি বড় একজন চিত্র সমালোচকও ছিলেন। তাঁর অনেক চিত্র সমালোচনামূলক লেখা আছে। তার মধ্যে আমি দুইটা প্রবন্ধের রেফারেন্স রেখেছি এখানে, একটার নাম ‘দি পেইন্টার অব মডার্ন লাইফ’।
বোদলেয়ার বলেছেন, ‘আধুনিক জিনিসটা একটা মনোভাবের ব্যাপার, এটা সময়ের ব্যাপার নয়, কাজেই আধুনিকতার মৃত্যু হতে পারে না অথবা আধুনিকতা প্রাচীনকালে ছিলো না এটা বলা যাবে না।’ বোদলেয়ার মডার্নিটির সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘মডার্নিটি ডাজ নট রিলেট টু এনি টাইম, ইট ইজ এন এটিচুড’। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগেই কিছু লোক আছে যারা মডার্ন আবার কিছু আনমডার্ন। এটা অনেকটা প্রগতি আর প্রতিক্রিয়ার মত। যদিও তাঁর এ সংজ্ঞাকে এখন কেউ প্রাধান্য দিচ্ছে না। প্রাধান্য দেঢার প্রয়োজন নেই বলে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে একটু ভুলভাবেই যেন আধুনিকতার সংজ্ঞাটা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাঝেমাঝে নদী যেমন বাঁক পরিবর্তন করে সাহিত্যও তাই করে। সেটাই আধুনিকতা”। উনার এই সংজ্ঞাতে ধুয়াসা ছাড়া আলো মিলানো ভার ! সত্য সুন্দর ও আকাঙ্ক্ষার বন্দরে আমাদের নিয়ে যায় না। কাজেই উনার সংজ্ঞাকে আপাদত স্থগিত রেখেই আমাদের সামনে যেতে হবে সভ্যতা ও প্রগতি সমান তালে সামনে যাচ্ছে বলে।
নতুন একটি ধারার সৃষ্টিকালে মতপার্থক্য থাকবেই। উত্তরাধুনিক কবিতা হিসাবে অনেকেই লিখবে কারোটা টিকে যাবে কারোটা ঠিকে যাবে না এটাই নিয়ম। উত্তরাধুনিককতা ও উত্তরাধুনিক কবিতা স্পষ্ট করতে গিয়ে কবি হাসান আব্দুল্লাহ বলেন,
“…পশ্চিমের শেখানো ভাষায়ও সরাসরি কথা বলা যুক্তিযুক্ত বলে সবক্ষেত্রে মনে হয় না। যেমন ‘নরটন’ থেকে প্রকাশিত পোস্টমডার্ন আমেরিকান ফিকশন’ সম্পাদক পলা গে , ডানিয়েল বেল বা ইহাব হাসানের মতোই মার্কিন পোস্টমডার্নিজমের উদ্ভব ষাট দশকে–এ কথা স্বীকার করে যখন এই প্রজন্মের সফল কবি হিসেবে এলেন গিন্সবার্গের কথা তোলেন–গোলমালটা তখনই লাগে। গিন্সবার্গ বিট গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান কবি হলেও মার্কিন কবিতার প্রেক্ষিতে কোনো বড়ো কবি নন, পুরো ইংরেজি কবিতার প্রেক্ষিতে তো নয়ই। আর ইংরেজি কবিতায় গিন্সবার্গই যদি উত্তরাধুনিকতার উদ্ভাবক হন, ডেরেক ওয়ালকট, সীমাস হিনি, জন অ্যাসবারিদের জায়গা কোথায়? এই পর্যায়ে বাংলা আধুনিকতার সাথে ইংরেজি আধুনিকতার একটি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা: ইংরেজি কবিতায় এজরা পাউন্ড, টি. এস. এলিয়ট, এডিথ সিটওয়েল মিলে যে আধুনিকতার শুরু করেছিলেন–সীমাস হিনি, ডেরেক ওয়ালকট, জন অ্যাসবারিরা তার পূর্ণতা টেনেছেন। ঠিক যেমনটি ঘটেছে বাংলা কবিতার তিরিশ ও পঞ্চাশের কবিদের দ্বারা। আর মার্কিনী উত্তরাধুনিকতার শুরু ষাটের দশকে নয়, আশির দশকের প্রারম্ভে–ইউসেফ কুমেনয়েকা, রবার্ট পিনসকি, জে. ডি. ম্যাক্লাচি প্রমুখ কবিদের হাতে। ভাব ভাষা ও ছন্দকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে কবিতার কাঠামো গড়ার শৈল্পিক প্রক্রিয়া মূলতঃ এঁরাই শুরু করেন।” (কবিতার জন্মদাগ, ‘উত্তরাধুনিক কবিতা: প্রচ্ছদে দুই বাংলা’, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৮)
রিচার্ড ডকিন্স বিষয়টা তাঁর ‘Postmodernism disrobed’ (1998) প্রবন্ধে ঠিক এভাবে দেখেন :
“Suppose you are an intellectual impostor with nothing to say, but with strong ambitions to succeed in academic life, collect a coterie of reverent disciples and have students around the world anoint your pages with respectful yellow highlighter. What kind of literary style would you cultivate? Not a lucid one, surely, for clarity would expose your lack of content.
The chances are that you would produce something like the following:
” We can clearly see that there is no bi-univocal correspondence between linear signifying links or archi-writing, depending on the author, and this multireferential, multi-dimensional machinic catalysis. The symmetry of scale, the transversality, the pathic non-discursive character of their expansion: all these dimensions remove us from the logic of the excluded middle and reinforce us in our dismissal of the ontological binarism we criticised previously. ”
মূলত উত্তরাধুনিকতার সূত্রপাত হয় আশির শেষের দিক থেকে । তখন কবিতায় আমাদের শিল্প ভাষা বদলে যেতে থাকে। উদ্ভব হতে থাকে নতুন ধারার কবিতার–উত্তরাধুনিক কবিতার। তবে, প্রকৃত সফলতা আসে নব্বই দশকে। সকল মতবাদের সমালোচনা আছে। উত্তরাধুনিক মতবাদ ঐশী কিছু নয়।
পোষ্টমর্ডানিজমের শুরু সেখান থেকে, যেখানে এসে বাস্তবতার দর্পনে ক্লাসিসিজম, রিয়ালিজম আর রোমান্টিসিজম বাকহারা হয়ে পরে। পোষ্টমর্ডানিজম মানে প্রচলিত সাহিত্য থেকে নজর সরিয়ে এমন এক সৃষ্টির সন্ধানে ধেয়ে যাওয়া যেখানে খুলে যাবে মুক্ত চিন্তার শত রুদ্ধদ্বার, দ্যুতি ছড়াবে ভাষার সাধারন শব্দ ভাণ্ডার, যোগাযোগ বাড়বে কবিতার সাথে পাঠকের, কবির এবং কবিতার।
সে সকল তত্ত্ব যার উৎপত্তি ভাষাভিত্তিক, মনোজাগতিক, প্রাচীন প্রাচ্য দার্শনিকতা ও বাম রাজনীতির বুদ্ধি ভিত্তিক সংগ্রাম থেকে উদ্ভব পোষ্টমর্ডানিজম সেসবের পূনঃভাবনার রেখা পথ ধরে হাঁটতে চায়। পালাতে চায় অতীতমূখীনতা থেকে, দৃঢ় হেঁটে যেতে চায় ভবিষ্যৎ অভিমূখে। সাহিত্যিক অনুপান ভেঙে প্রবল ভাবে অস্বীকার করে চলে আসা সকল মহান শিল্পরীতি নীতি, গন্ডিবদ্ধ চেতনা থেকে মুক্তি দিতে চায় পাঠকের ভাবনাকে। আমার মতে মূলত চারটি ভিত্তির উপর ভর করে দাঁড়িয়েছে পোষ্টমর্ডানিজম। এগুলো হল– ১. প্রতিকায়নের বিরোধীতা করা
সংস্কৃতির যে মিথস্ক্রিয়া হয় সে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। সেই সাথে মনে রাখতে হবে যুগভেদে সংস্কৃতির তুলাদণ্ডের বৈচিত্র্যতার কথা। উত্তরাধুনিক কবিরা সাংস্কৃতিক তুলাদণ্ডের মাপকাটিকে অস্বীকার করে পূর্ববতী সকল শিল্প যা মহান সৃষ্টি বলে স্বীকৃত তাকে বাতিলের ঘোষণা না দিয়ে তার উদ্দেশ্য বা কীর্তিটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে সকল নৈতিকতা, এথনিক সত্বা, লিঙ্গ বৈষম্য না মেনে সাহিত্য চর্চার সকল চৌহদ্ধি মাড়িয়ে সবার উপরে মানুষ সত্যের জয়জয়কার ঘোষণাই পোষ্ট মর্ডানিজমের প্রতিকায়নের বিরোধিতার মুল উদ্দেশ্য। পোষ্টমর্ডানিজম কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চায়নি। সাধারণভাবে শ্রেষ্ঠত্বের যে সংজ্ঞা পোষ্ট মর্ডানিজম তা মানতে চায়নি। জীবন ও শিল্পের যে দ্বান্ধিকতা তার মাত্রায় ভর করে পরাবাস্তবাতার মিশেল বা বহুমূখী সমাপ্তির সন্ধান খুঁজতে চান পোষ্ট মর্ডানিস্টরা। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার দায়টা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিতে চান তারা। এটা অনেকটা এ কালের “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার” ছবির মত। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী কাহিনির পরিসমাপ্তির সিদ্ধান্ত যেমন দর্শকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন একালের উত্তরাধুনিক কবিরাও তাদের দায়টা পাঠকের উপর ছেড়ে দেন। তারা পাঠকের পছন্দনীয় মতের প্রতিষ্ঠার অগ্রাধিকার চান। পাঠক যাতে কবিতায় খুঁজে নিতে পারে তার স্থান, নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। চিত্তকে দোলায়িত করার পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়।
বিশিষ্ট আধুনিকরা কবিতায় সুর, ছন্দ আর সৌন্দর্যচর্চার বহুমূখীনতা নিয়ে কাজ করেছিলেন। উত্তরাধুনিকতা সে ধারাটিকে ভেঙে ফেলতে চাইল। আর তাই আবেগকে রুপদানের ক্ষেত্রে তারা অনুসরণ করল সার্বজনীন গল্প বলার স্টাইল, কৌতুক উদ্দীপক বা হাস্যরসাত্মকতার, কখনো বা উপস্থাপন করল প্রচলিত কোন ধ্যানধারণার মতো করে যা তেমন কোন অর্থবোধক নয়। আর তাতে মিশ্রণ হয়ে এল নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক উপজীব্য। উত্তরাধুনিকরা চাইল তাদের সৃষ্টি জনপ্রিয় হয়ে উঠুক। তাই তারা অনুসরণ করল সাধারণ গণমানুষের কথ্যভাষা, কখনো বা প্রচলিত সাধারণ শব্দ সমষ্টি। আর তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আকর্ষণীয় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে বাস্তবতার কঠিন অনুষঙ্গগুলি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়াই হল মূখ্য উদ্দেশ্য। মোট কথা এমন মিডিয়া ইমেজ সৃষ্টি করা যাতে মাত্রাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তির কঠিন ইটে নির্মিত শিল্পবাড়িটাকে সজোরে নাড়িয়ে দেয়া যায়।
অনেক পাঠকই উত্তরাধুনিক কবিতাকে কোন কবিতা বলে স্বীকার করতে চান না। উত্তরাধুনিক সংজ্ঞাটিকেও মানতে চান না তারা। এর কারণ হিসেবে চিহ্নত করা হয় কতিপয় পোষ্টমর্ডানিজের স্ব তরিকায় নির্মিত কাব্য সৃষ্টি সমূহকে। যা মূখ্যত তাদের সুবিধার জন্যে পোষ্টমর্ডান বলে দাবি করেন। কিন্তু তা বলে পোষ্টমর্ডানিজরা দমে যায়নি। জীবন ও তত্ত্ব এড়িয়ে তাদের হাতে জন্ম নিয়েছে এবং নিচ্ছে অসাধারণ সব সৃষ্টি। হয়ত খুব দ্রতই আবার পরিত্যক্ত হবে এ মতবাদ পুরোনো সকলের মতো। তবু পোষ্ট মর্ডানিজম শিল্পকে প্রাত্যহিক লোকমানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসার যে সফলতা দেখিয়েছে সেটিই তাকে আয়ু দেবে বহুদিন।
প্রকৃত পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ততাই থেকেই সেরা কিছুর সৃষ্টি হয়। বাংলা কবিতা নানা পর্ব ও ইতিহাসের অনেক গভীর রহস্যময় উপত্যকা পেরিয়ে এসেছে। এভাবে আধুনিকতার পর্ব পেরিয়ে এখন উত্তরাধুনিকতার ধূসর জগতে হাঁটছে। আর এ ধারার একজন সফল কবি হলে জফির সেতু।
আমরা যখন উত্তরাধুনিক সাহিত্য, কবিতা ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করি; তখন অনেকটা অবচেতনে উপনিবেশিক প্ররোচণার শিকার হই। বিশেষ করে উত্তরাধুনিক কবিতার যে দেশজ ভাব সম্পদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অপরদিকে আধুনিক যুগের কবিতার লক্ষ্য ছিল পাশ্চাত্য অনুসরণ। যদিও চেতনার মাঝে প্রতিফলন ছিল নিজস্বতার। উত্তরাধুনিক পর্বের সবার লেখাই হয়ত আলোচনা করার মত নয়। অনেক গৌণ কবিও রয়েছেন। তবে সাহিত্য নদীতে একটা ঢেউ হিসেবে স্রোতকে গতিময়তা দিতেও একজন গৌণ কবি সহায়ক শক্তি তা কিন্তু বলতেই হবে। গৌণদের হয়ত গণনা করা যায় না,করার প্রয়োজন পড়ে না বলে। উত্তরাধুনিক কবিদের মধ্যে জফির সেতুর কবিতা সন্ধ্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। যে কারণে তার কবিতা হাজার কবিদের ভিড়েও খুঁজে বের করা সম্ভব। কবিতার উপকরণ, প্রকরণ, ভাব, ভাষা, অলংকরণ, শব্দ শিল্পের শৈল্পিক ব্যবহার সর্বোপরি কবিতায় নতুনত্ব আনয়নে নিঃসন্দেহে তাঁর কবিতা প্রশংসার দাবিদার।
মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট