উত্তরাধুনিকতা ও কবি জফির সেতুর কবিতা কাব্য বিশ্লেষণ/ কাব্য সমালোচনা পর্ব-২

ফয়সাল কবির
ফয়সাল কবির - ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
8 মিনিটে পড়ুন
635681491493377583 wilderness in blue far away from concrete উত্তরাধুনিকতা ও কবি জফির সেতুর কবিতা কাব্য বিশ্লেষণ/ কাব্য সমালোচনা পর্ব-২

সাময়িকী.কম

কোন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টার কারণে দশকও পরিচিত হয়ে উঠতে পারে আবার কোন দশকের মধ্যে না থেকেও কোন কোন ব্যক্তির সৃষ্টকর্ম দশকের উর্ধ্বের আলোচনায় আসতে পারে। যেমন নজরুলের কবিতাকে প্রকৃতপক্ষে কোন দশক দিয়েই নির্ণয় করা যায় না। যারা তা করার চেষ্টা করেন তারা যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত খুঁজেন। তবে কবি নজরুলেরও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল যে রকম সীমাবদ্ধতা আমরা দেখতে পাই পল্লি কবি জসীমউদদীনের মধ্যে। জসীমউদদীনের কবিতায় শব্দের প্রাঞ্জলতা রয়েছে বাংলা কবিতায় নতুনত্ব আনয়নে, গ্রামীণ আঞ্চলিক শব্দের সুনিপুন ব্যবহারে তার ভূমিকা অপরিসীমতবুও তাঁর চিন্তার সংকীর্ণতা ছিল। কেবল গ্রামীণ প্রকৃতি ও জনজীবনকেই তিনি তার কাব্যে প্রধান উপজীব্য করে ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেছেন। এর বাহিরে যেন আর কোন কিছু নেই; তিনি দেখেও দেখতেন না, শুনেও যেন বুঝতেন না। বিশ্বমানের সাহিত্যিক হওয়ার জন্য যা প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তাঁর চিন্তা ধারা ছিল অনেকটা কুয়োর ব্যাঙের মতকুয়োর ব্যাঙ যেমন পৃথিবীকে আড়াই হাত মনে করে তেমনি জসীমউদদীনও তাঁর সাহিত্যজগৎকে সংকীর্ণ করে ফেলেছিলেন কেবল একটি অঞ্চল বেছে নিয়েবিশ্বমানের সাহিত্যিক হতে গেলে ক্ষুদ্র অঞ্চল প্রীতি এবং সে অঞ্চলের উপকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মোটেও সমীচীন নয়।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনার শিল্পগুণ প্রবন্ধে বলেছিলেন,“তুমি যাহা লিখিবে লোকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারেযাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা” কিন্তু আফসোস! তাঁর এই বাক্যদ্বয়ের মর্মার্থ উনি নিজে বুঝে যদি ওনার সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারতেন তবে তা হয়ত সত্যিকার অর্থেই সার্থক হয়ে ওঠত। যাই হোক, ভাষার কাজ হচ্ছে সরলীকরণ। আর সে সরলীকরণের সুবাতাস একবার বইতে শুরু করলে সাহিত্যের সকল শাখাকেই তা ছুঁয়ে যায়। উত্তরাধুনিক যুগের অনেক কবিই নিজের কবিতাকে স্বতন্ত্রধারায় নিয়ে আসলেও শব্দের কাঠিন্য থেকে মুক্তি দিতে পারেন নি। যিনি কবিতাকে জড় ধর্ম থেকে মুক্তি দিয়ে সজীব করে তুললেন ভাষার সরলীকরণ দিয়ে, উত্তরাধুনিকতার খোলসকে যিনি স্বীয় সৃষ্টিশীলতার নৈপুণ্য উন্মোচিত করে তুললেনে, শব্দের দুর্বোধ্যতাকে যিনি ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন কাব্য থেকে, বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যিনি পরিমিতি বোধ দেখিয়েছেন তিনি হলেন উত্তরাধুনিক যুগের কবিতার প্রাণভ্রমরা ড. জফির সেতু। পাঠককুল তাঁর কাব্যগ্রন্থ পাঠমাত্রই আমার কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন।

বাংলা চলচিত্রাঙ্গে আনোয়ার হোসেনকে প্রায় সব ছবিতেই স্টোক করে মারা যেতে দেখা যায়। এটি এতবারই হয়েছে যে সাধারণ মানুষ ধরেই নিত আনোয়ার হোসেন মানেই স্ট্রোক! ছবিতে কখন সে মারা যাবে তাও সাধারণ দর্শক আঁচ করতে পারতযা গিনেজ বুক অব ওয়াল্ডে রেকর্ডেরও দাবি রাখে! বিষয়টা ওখানেইগতানুগতিক ধারা কখনোই কাম্য নয় তাও আবার সেরাদের কাছ থেকে। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তির কারণে যেমন একঘেয়েমি চলে আসে তেমনি শিল্প সফলতাও নষ্ট হয়। তথাকথিত অনেক উত্তরাধুনিক কবির প্রধান বিষয়বস্তুই ঈশ্বর এবং ধর্ম। শব্দের চাকু দিয়ে যা পুনঃপুনঃ ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। এই একই কারণে সে সব কবিতা শিল্প সফলতা থেকে ছিটকে পড়েছে।

প্রথা ভাঙ্গার চর্চা নিয়ে কবিতায় এসেছিলেন ড. হুমায়ুন আজাদ ও তসলিমা নাসরিন প্রমুখরা। যা কাসেম বিন আবুবাকার ও ধর্মীয় রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ আলমাহমুদের সৃষ্টিশীলতার বিপরীত। অর্থাৎ একই মুদ্রার যেন এপিঠ ওপিঠ। অথাৎ একদল প্রথা ভাঙতে চাইতো আর আরেক দল চাইতেন প্রথা শক্ত করতে।

এই ভাঙ্গা এবং শক্ত করতে গিয়ে সাহিত্যের শিল্প সৌন্দর্য থেকে তারা অনেকটাই ছিটকে পড়েছিলেনযা সাধারণ পাঠ মাত্র আঁচ করা সম্ভব নয়। কেবল একটু সূক্ষ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেই আমার কথার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। সাহিত্যে একক উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থাৎ ধর্মের চর্চা ক্রমাগতই করলে তা শিল্পগুণ থেকে বিচ্যুত হবে এটাই স্বাভাবিক; আর প্রগতিশীলতার নামে কবিতার চরণে চরণে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করলেও যে তা শিল্প সফল হবে তেমনটি ভাবা মোটেও ঠিক নয়। বরং প্রকৃত চিত্র হল অনায়াসে তা শিল্প ধর্ম থেকে বিচ্যুত হবে। এদিক থেকে পুরুটাই ভিন্নধর্মী ভাব, ভাষা, অলংকরণ ও শব্দের সুনিপুন সন্নিবেশ ও বিচিত্র উপস্থাপনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন কবি জফির সেতু।

শতাব্দির শুরু হয়ে গেলে পিছন ফিরে তাকানোর নয়, তবুও তাকাতে হয়।  এরপর বিচার করে দেখা যেতে পারে নিজেদের হালহকিকত, সৃষ্ট কর্মের অবনতি ও উন্নতি আধুনিক যুগের প্রারম্ভে এসে আর কিছু না হোক, অন্তত পশ্চিমের একটা শিক্ষা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলাম আমরাযদিও পরিস্থিতির দৈবপাকে পড়ে আমাদের সে শিক্ষা রপ্ত করতে হয়েছে।  পশ্চিমা ফসল হল বিভাজননীতি। শিল্প ও সাহিত্যকে খণ্ড, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন করে দেখা। কালের ঘূর্ণাবর্তে সে বিচ্ছিন্নতা এতদূর প্রসারিত যে, কখনো বা মূলের সঙ্গে শাখা সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। সূক্ষ দৃষ্টিতে খেয়াল করলে তখন মনে হবে- মূল ও শাখা উভয়েই যেন দাবি করে বসছে বৃত্তের উপর কর্তৃত্বের। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস ছিল অখন্ড, সাহিত্যের পরিসর ছিল অসীম। দুঃখজনক হলেও সত্য, পশ্চিমা প্রভাবের কারণেই আজ সেথা বিভক্তি তথা বিভাজনের স্পষ্ট রূপ দেখা যাচ্ছেদশকের হিসাব আসা মাত্রই সে অখণ্ডের খণ্ড রূপ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। যদি আরও স্পষ্ট করে বলি তাহলে বলতেই হয়, আমাদের এই ভূখণ্ডে ছিলো খণ্ডকে অখণ্ডে, ক্ষুদ্রকে বৃহতে, সীমাকে অসীমে টেনে নেবার প্রয়াস। ছিলো একের অনলে বহুকে আহুতি দেবার মন্ত্র। অর্থাৎ সমন্বয় ও সংশ্লেষের সাধনা।

মূলত উত্তরাধুনিকতাবাদ সমকালীন চিন্তাজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি শব্দ। একটি বহু বিতর্কিত অভিধা। স্তুতি, নিন্দা, সমর্থন, অসমর্থন নির্বিশেষে উত্তরাধুনিকতাবাদ একটি বিপুল আলোচিত বা সমালোচিত একাডেমিক প্রপঞ্চ। অতি অল্প সময়ে বিষয়টি এত প্রচার ও প্রসার পেয়েছে যে তার সাথে একমত কিংবা দ্বিমত পোষণ করা সহজ, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করা সহজ নয়।

অবশ্য তা হয় নি। তবে যা হয়েছে তা হল অতি স্তাবকতা অথবা অতি কুৎসা কিংবা যথেচ্ছ ব্যবহার; সাহিত্য শিল্পকলা, চলচিত্র, স্থাপত্য, সমালোচনাতত্ত্ব, ইতিহাস ও দর্শনের জগতে। এজন্যই হয়ত সাহিত্যবোদ্ধা উমাবার্তো ইকো আফসোস করে বলেছেন, “উত্তরাধুনিকতাবাদ একটি দুর্ভাগ্যজনক শব্দ”।  তবে এ্যান্ডিয়াস হাইসেন একই সাথে আশা ও সতর্কতা উভয়ই প্রকাশ করেছেনতিনি বলেন, “উত্তরাধুনিকতাবাদকে নিয়ে স্তব কিংবা বিদ্রুপ কোনটাই করা উচিত নয়। তাকে অবশ্যই তার সমর্থক এবং নিন্দুক উভয়ের হাত থেকেই বাঁচতে হবে। মূলত উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হলো সাহিত্য শিল্পকলা ও দর্শন। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কেবল সাহিত্যেই উত্তরাধুনিকতাবাদের অপ্রত্যাশিত প্লাবন হয়েছে।

যুগের বৈশিষ্ট্যকে অনেকেই লালন করেন তাদের সৃষ্ট সাহিত্যে। যেভাবে উত্তরাধুনিকতাবাদকে লালন করছেন একালের কবিরা। যদিও সে বৈশিষ্ট্যকে লালন করতে গিয়ে অনেকেই হারিয়ে যায় শূন্যতার অতলে। আমি মনে করি কোন সৃষ্টিই ক্ষুদ্র নয়। তা সে প্রাচ্যেই হোক আর পাশ্চাত্যেই হোক। সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ দরদ দিয়েই তা শৈল্পিক করে তুলতে হয়। আর সে দিক থেকে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখেন একালের অন্যতম সেরা কবি ড. জফির সেতু। তিনি তার কবিতাকে যেন সন্তানসম স্নেহে গড়ে তুলেছেন। সন্তানের মাঝে যেমন ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নের বীজ বপন করতে হয় ঠিক তেমনি তিনি তার কবিতায় তার প্রগতিশীল চেতনার সোনালি বীজ বপন করে চলেছেন আপন মনে।

 (চলবে)

মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট,  সিলেট

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
অনুসরণ করুন:
কর্মজীবী এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!