সাময়িকী.কম
মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে অনেক সৃষ্টিই ম্লান হয়ে যায় কালের গর্ভে । সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে হারিয়ে যায় ব্যক্তিসত্ত্বা কেবল টিকে থাকে ব্যক্তির সৃষ্টিশীল কর্ম। এই জন্ম এবং হারিয়ে যাওয়ার খেলা প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরে চলে আসছে। ক্ষণ জীবনের অধিকারী হয়ে অনেকেই ঠাঁয় করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনার পাতায়। নিজের সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে মহাকালের বিমূর্ত পাতায় ব্যক্তিমানসও বেঁচে থাকে শতাব্দির পর শতাব্দি।
বিশ্বজোড়া সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার ঘটনা ঘটে চলছে নিত্য। সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেও সংস্কৃতির পরিবর্তন আসতে পারে, পরিবর্তন আসতে পারে সামাজিক অবকাঠামোর, নীতি-নৈতিকতার। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া বহমান নদীর বাক পরিবর্তনের মতই। নদী যেমন কখনো সোজা পথে চলতে পারে না তেমনি সাহিত্যের ধারাও কখনো সোজা পথে চলে নি। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের পরশে কখনো কখনো সে গতিপথের পরিবর্তন হয়েছে। যাদের মাধ্যমে সাহিত্যে তথা কাব্যে নতুন ধারার সৃষ্টি হয় বা নতুন গতিপথের সঞ্চার হয় তাদের আমরা বলি প্রধান সাহিত্যিক বা প্রধান কবি।উত্তরাধুনিক যুগের তেমনি একজন সাহিত্যিক বা কবি হলে জফির সেতু।
এরিস্টটলীয় যুগে, এরিস্টটলের জ্ঞানের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সমকালীন জনসাধারণেরা মনে করত এরিস্টটলের বাইরে পৃথিবীতে কোন জ্ঞান নেই, থাকতে পারে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ভূগোল, আইন, রাষ্ট্র, চিত্রাঙ্কন, সাহিত্য সৃষ্টি, সাহিত্য সমালোচনা, ভাস্কর্য নির্মাণ প্রভৃতি হেন কোন বিষয় নেই যে শাখা নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করেন নি । যদিও ধারণাটি অমূলক এবং পরবর্তীতে এরিস্টটলের চিন্তারও অনেক অসারতা প্রমাণিত হয়েছে তথাপিও এ কথা অনস্বীকার্য যে, তৎকালীন সময়ে কেবল তার সৃষ্ট কর্মের মাধ্যমেই তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এখনো অনস্বীকার্য। যুগে যুগে এমন অনেক প্রতিভাবানরা সমকালীন মানুষদের তাঁদের সৃষ্ট কর্মের সম্মোহনী জাদুর মাধ্যমে সম্মোহিত করে রাখেন। আবার এর বাইরে বের হওয়ার জন্য অনেকেই আবার চেষ্টা করেন। সভ্যতার লগ্ন থেকেই এমন নজির অহরহ। এরিস্টটলের সময়েও অনেকে তার সৃষ্টিশীলতার বলয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিল।
এমনি আরেকটি নজির দেখতে পাই আধুনিকতার শুরুতে। সাহিত্যে যখন মানবিকতা ও যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হল তখন সাহিত্যের গতিও তরতর করে পরিবর্তিত হতে থাকল। সাহিত্যে নতুন নতুন উপকরণ ও নতুন নতুন ধারা নিয়ে বাংলা সাহিত্যেকে পৃথিবীব্যাপি পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন বিষ্ময়ী বিশ্বকবি খ্যাত সাহিত্যের নতুন সওদাগর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন গ্রহ-নক্ষত্রগুলো তার নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হয় তেমনি তৎকালীন সময়ে রবি ঠাকুরকেও সৌরজগতের নক্ষত্রের মত মধ্যমণি মনে করা হত। রবি ঠাকুরের সৃষ্ট ধারাতেই সকলে সন্তুষ্ট থাকত এবং কি তার নির্দেশিত ধারা অনুসরণ করেই তৎকালীন সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করত। সাহিত্যের সকল শাখা-প্রশাখাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। কেবলমাত্র মহাকাব্য রচনা ছাড়া বাকী সব শাখা-প্রশাখাতে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন।
তাঁকে তুলনা করা করা হয় বটবৃক্ষের সাথে। বটবৃক্ষের যেমন অনেক শাখাপ্রশাখা থাকে তেমনি রবি ঠাকুরেরও রয়েছে সাহিত্যের বিবিধ শাখা-প্রশাখা। বটগাছের নিচে যেমন অন্য কোন গাছ জন্মাতে পারে না তেমনি রবি ঠাকুরের সৃজনী বলয়ের প্রভাবেও তৎকালীন সময়ে অন্য কেউ নতুন করে সাহিত্যের ধারা পরিবর্তনের সাহস করে নি। ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করত, মানত। চারদিক তখন ক্রমশই রবি বন্দনায় মুখর হয়ে ওঠতে থাকে। দীর্ঘকাল তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে চলতে থাকলো সাহিত্য সাধনা। কিন্তু এ শক্তিশালী বলয়ে প্রথম আঘাত হানে বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত উদিয়মান পাঁচজন তরুণ কবি। এরা হলেন বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ।
রবি ঠাকুরের ভাব, ভাষা, অলংকার, ছন্দ, উপমা প্রত্যেকটি জায়গাতেই তারা আক্রমণ করেছেন। মার্কসীয় দর্শন তাদের কাব্যে ঝংকৃত হতে থাকে। চরম মানবিকতাবোধ, দেশপ্রেম, জীবন জটিলতা, সমকালীন বাস্তবতা তথা নিটোল বাস্তবতাবোধ তাদের কাব্যে ফুটে ওঠতে থাকে। এই পঞ্চপাণ্ডবরাই ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন বস্তুবাদী কবি হিসেবে। যদিও এদের অনেকেই মার্কসীয় দর্শনের কথা স্বীকার করতে চান না তথাপিও তাদের সৃষ্ট সাহিত্যে সে প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করার মত নয়। রবি ঠাকুরের বলয়কে তারা দুমরে-মুচরে ফেলেছেন নিজেদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে। একদিকে যেমন প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্রে’র যুক্তির কাছে সাধুভাষার প্রতি তাঁর প্রীতি চরমভাবে ধুলিসাৎ হল অপরদিকে নতুন প্রজন্মের এই তরুণেরা তাকে ভেঙ্গে যেন নতুন করে সৃষ্টি করতে লাগলেন।
সমুদ্রে প্রচণ্ড জোয়ারের সময় যেমন নৌকাস্থ সব জিনিস উলট-পালট হয়ে যায়, তেমনি এই পঞ্চপাণ্ডবদের নতুনত্বের প্রভাবে তাঁর চেতনার মধ্যেও তেমন ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলতে থাকে। অবশ্য তিনি নতুনদের মেনে নিয়ে ছিলেন যেভাবে মেনে নিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরীরর চলিত ভাষায় সাহিত্য রচনা করার কথা। আর না মেনে নিয়েই বা উপায় কী! পঞ্চপাণ্ডবদের প্রভাবে তখন সাহিত্যে সংযোজিত হতে থাকে নতুন ধারা ও নতুন প্রকরণ। তাঁরা রবি ঠাকুরের ছন্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছেন। তিরিশের দশক ও তার পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ তো রবি বাবুকে কটাক্ষ করে বলেই ফেলেছেন– “বুড়ো হয়ে গেছ তুমি, এ বুড়ো পৃথিবীর মতন”।
মনের ভাব প্রকাশ সম্পূর্ণ না করে ছন্দ নিয়ে টানাটানি করলে যে মূলভাব থেকেই বিচ্যুত হতে হয় এটা সকলেই জানে; কেবল এই কথাটিই নতুন করে তারা সকলকে জানান দিল। তাদের থেকে নতুন করে সৃষ্টি হল দশকের গণনা। তিরিশের দশককে তারাই পরিচিত করে তুললেন বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে। যদিও তাদের আগে অনেকেই লিখেছেন তবুও তাদের থেকেই সাহিত্যে দশক সৃষ্টির হিসাব বহুলভাবে প্রচারও প্রসার হতে থাকে।
সাহিত্যে এভাবেই চলতে থাকে বলয় সৃষ্টি এবং বলয় ভাঙ্গার প্রচেষ্টা। এটা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বরং বিশ্বের সকল সাহিত্যই এমন নজির অহরহ মিলে। এর পরের দশকগুলোতে অনেকেই উঠেছেন আবার অনেকেই হারিয়ে গেছেন কালের স্রোতে। পঞ্চপাণ্ডবদের পরে যিনি একক প্রচেষ্টায় সাহিত্যে আবারও নতুন বলয়ের সৃষ্টি করেছেন তিনি হলেন প্রগতিশীল কবি শামসুর রাহমান।
তাঁর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সমকালীন বাস্তবতা। মূলত নগর জীবনের জটিলতাই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। নগর কেন্দ্রীক চিন্তাভাবনার কারণে যদিও তাঁর চিন্তা গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ে তথাপিও তিনি সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্রধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। সেরাদের কাছে সব সময়ই সাধারণদের একটু বেশিই প্রত্যাশা থাকে। ফুটবল বিশ্বেও যেমন সেরা খেলোয়ার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিউনেল মেসি, নেইমার প্রমুখদের প্রতি সাধারাণ জনতার একটু বেশি প্রত্যাশা থাকে সে রকমই সৃজনশীল পাঠকদের প্রত্যাশা ছিল কবি শামসুর রাহমানের কাছে। বিশ্বমানের হতে গেলে মনকে বিশ্বমানের করে গড়ে তোলা উচিত, চিন্তাকেও সুদূরপ্রসারি করা উচিত। শুধু শহরকেন্দ্রিক করে গড়ে তোলা উচিত নয়, কেননা তাতে চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতা থাকে আর সে কারণেই তা বিশ্বমানের হয়ে ওঠে না।
শামসুর রাহমান সাহিত্যে প্রগতিশীলতার চর্চা করতেন। সকল প্রকার কুসংস্কারের বলয় থেকে তিনি নিজে মুক্ত ছিলেন। তাঁর কবিতাকেও তিনি সে বলয় থেকে মুক্ত রেখেছিলেন। আর এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আর সে মুক্ত চিন্তার ছাপই আমরা দেখতে পাই তার সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে। বাংলা কাব্যে গদ্য কবিতার ধারাকে তিনি সবচেয়ে বেশি সফল করে তুলেছেন।কবিতায় রাজনৈতিক দর্শনও তিনি ফলাও করে প্রচার করতে থাকেন। যদিও একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মীর কাছে এটা কখনোই কাম্য নয়।
পরবর্তীতে কবি শামসুর রাহমানের এই কাব্য বলয় থেকে এবঝাঁক তরুণ কবিতাকে মুক্তি দেয়ার জন্য ভিন্ন ধারার সৃষ্টি করতে থাকে। রাজনৈতিক দর্শনের জরাগ্রস্থতা থেকে কবিতার মুক্তি খুঁজতে থাকে। চিন্তাকে বিশ্বমানের করে তার ছাপ ফেলতে থাকেন তাঁদের সৃষ্ট কাব্য সাহিত্যে। কবিতায় শুরু হতে থাকে নতুন প্রকরণ। ১৯৯০ এর পর থেকে কবিতার প্ল্যাটফরমও বদলে যেতে থাকে।
কাব্য সাহিত্যে শুরু হয় নতুন দিগন্ত। যুগের ঘরে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয় একটি শব্দ ‘উত্তরাধুনিক’। উত্তরাধুনিক পর্বের গণনায় ও বৈশিষ্ট্যে সকল কবিতাকেই ধরা হয় উত্তরাধুনিক কবিতা। উত্তরাধুনিক যুগের নতুন ধারার একজন সফল কবি হলেন জফির সেতু। তাঁর বহুবর্ণ রক্তবীজ, সহস্র ভোল্টের বাঘ, স্যানাটরিয়াম, তাঁবুর নিচে দূতাবাস, সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী, জাতক ও দণ্ডকারণ্য, সূতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা, ময়ূর উজানে ভাসো, Turtle has no wings. প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে উত্তরাধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন।
(চলবে)
মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট